শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘দুর্নীতিবাজ’রা বাদ, সাক্ষী কারাগারে

প্রকাশিত: ১১:৪০ এএম, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১

‘দুর্নীতিবাজ’রা বাদ, সাক্ষী কারাগারে

রংপুর সিটি করপোরেশনের (রসিক) ঠিকাদারি কাজের জন্য গণমাধ্যমে দরপত্র প্রকাশ না করে ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল বিভাগের যোগসাজশে ৩০ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেওয়ার ঘটনায় মূল অভিযুক্তদের আড়াল করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। উল্টো ওই প্রতিষ্ঠানের সাবেক আলোকচিত্রী ও বগোলজার রহমান ওরফে আদর রহমানকে সাক্ষী থেকে আসামি করে দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই মামলায় গত বুধবার র‌্যাব-১৩-এর একটি দল তাঁকে রংপুর মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আতাউর জামান বাবুর ইঞ্জিনিয়ারপাড়ার বাসভবন থেকে আটক করে। পরে মহানগরীর হারাগাছ মেট্রোপলিটন থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। বৃহস্পতিবার তাঁকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। প্রায় আড়াই বছর আগের ওই ঘটনাটি জানাজানি হলে প্রথমে সংশ্লিষ্ট দুই প্রকৌশলী ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগের মামলার তদন্ত শুরু করে দুদক। সংশ্লিষ্ট ওই দুই প্রকৌশলী রসিকের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আকতার হোসেন আজাদ, যিনি বর্তমানে দুদকের পরিচালক হিসেবে কর্মরত এবং তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন, যিনি পদোন্নতি পেয়ে এখন রসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। সে সময় ওই মামলার সাক্ষী ছিলেন আদর রহমান। অভিযোগ রয়েছে, পরে ওই প্রভাবশালী চক্রকে রেহাই দিতে সাক্ষী আদর রহমানকেই একমাত্র আসামি করে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে অভিযোগপত্র দেন জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক নূর আলম। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে গোলজার রহমান ওরফে আদর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অভিযোগ করেন, প্রভাবশালী প্রকৌশলীদের আড়াল করতেই তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। চাকরির শর্ত অনুযায়ী দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও অনুমোদনের কোনো ক্ষমতা তৎকালীন সিটি মেয়রের আলোকচিত্রী গোলজার রহমান ওরফে আদর রহমানের ছিল না। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী দরপত্রসহ সব কাজে সই করেন। এ ঘটনার দায় থেকে তাঁদের আড়াল করতেই কৌশলে আলোকচিত্রীকে আসামি করা হয়েছে। জানা গেছে, দরপত্র সংবাদপত্রে প্রকাশে আলোকচিত্রী-কাম-জনসংযোগ সহকারীর কোনো ক্ষমতা বা প্রমাণ না থাকলেও তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আকতার হোসেন আজাদের একটি প্রত্যয়নপত্র আদালতে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। সাক্ষীকে আসামি বানানোর মামলার অভিযোগপত্রে সে সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্বাক্ষর করার ক্ষমতা থাকার কারণে অভিযুক্ত হতে পারেন এই শঙ্কায় কর্মকর্তা আকতার হোসেন আজাদ ও এমদাদ হোসেনও হন সাক্ষী। সাক্ষী করা হয়েছে এক বছর আগে মারা যাওয়া স্থানীয় দৈনিক দাবানলের সম্পাদক খন্দকার গোলাম মোস্তফাকেও। ঘটনার সময় মেয়রের দায়িত্বে প্রয়াত সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু থাকলেও সাক্ষী করা হয়েছে বর্তমান মেয়র মোস্তাফিজুর রহমানকে। বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পরই ২০১৮ সালের মার্চে রসিকের ১৭৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে (অস্থায়ী নিয়োগ) ছাঁটাই করা হয়। সে সময়ই ছাঁটাই হন সাক্ষী থেকে আসামি বনে যাওয়া আলোকচিত্রী (ক্যামেরাম্যান) গোলজার রহমান ওরফে আদর রহমান। প্রভাবশালী চক্রকে রেহাই দিতেই গোলজার রহমানকে ফাঁসানো হচ্ছে—এমন অভিযোগের ব্যাপারে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা নূর আলম বলেন, ‘মামলার অভিযোগে যেমন ছিল, সে অনুযায়ী প্রতিবেদন দিয়েছি। প্রয়াত মেয়র ঝন্টু ওই দুর্নীতি করেছেন এবং গোলজার তাঁর সহযোগী।’ তবে যাঁরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, তাঁদের দায় নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনো উত্তর দিতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তা। আসামি গোলজার রহমানের পরিবার জানায়, সিটি করপোরেশনের সাবেক কর্মকর্তা আকতার হোসেন আজাদ পরে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত হন। সম্প্রতি তিনি দুদকের তদন্ত শাখার পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এমদাদ হোসেনও বর্তমান মেয়র মোস্তাফিজুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। গোলজার রহমানকে সে সময় ছাঁটাই করা হলেও অভিযোগপত্রে লেখা হয় ‘বরখাস্ত’। তিনি ক্যামেরাম্যানের দায়িত্বে থাকলেও অভিযোগপত্রে তা এড়িয়ে তাঁকে সহকারী জনসংযোগ কর্মকর্তা বলা হয়। গ্রেপ্তারের আগে গোলজার রহমান ওরফে আদর রহমান জানান, হঠাৎ সাক্ষী থেকে তাঁকে আসামি বানানোর তথ্য পেয়ে অবাক হন। প্রভাবশালীদের চাপে তাঁকে মামলার একক আসামি করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি দুদক চেয়ারম্যানের কাছে পুনরায় তদন্তের আবেদন করেন। গত ২৯ মার্চ দুদকের সহকারী পরিচালক মানসী বিশ্বাস স্বাক্ষরিত দুদকের পাঠানো পত্র অনুযায়ী জানা যায়, এমদাদ হোসেনের অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য দুদক থেকে কাগজপত্র তলব করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের ৩৩টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় সড়ক বাতি স্থাপন প্রকল্পের প্রাক্কলন ব্যয় ও স্পেসিফিকেশন, দরপত্র খোলার বিবরণী, কার্যাদেশ, পরিমাপ, বাজার দর যাচাই-বাছাই কমিটির অনুমোদনের সব কাগজপত্র নিয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ অনুসন্ধানের স্বার্থে মেয়রের কাছে রেকর্ডপত্র তলব করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন ক্ষমতার দাপটে চরম দুর্নীতি ও অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে সিটি করপোরেশন থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন; তাঁর এসব অনিয়মের ঘটনায় ভুক্তভোগী কয়েকজন দুদক কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মন্ত্রণালয়ের পাঁচটি প্রকল্পের দায়িত্ব পালনকালে নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে কাজ পাইয়ে দিতে চরম দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। এমনকি সাবেক মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর স্বাক্ষর জাল করে সব টেন্ডারের নথি পরিবর্তন করে গুরুতর অপরাধের আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডের জলাবদ্ধতা ও অবকাঠামো উন্নয়নের ২১০ কোটি টাকার হিসাব, রংপুরের বিভিন্ন সড়কের পুনর্বাসন ও উন্নতি প্রকল্পের ২৫ কোটি টাকা, সড়ক বাতি স্থাপনের ৪৯ কোটি টাকা, যানবাহন ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ১১৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, অবকাঠামো ও ড্রেন-কাম-ফুটপাত নির্মাণে ৬০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে উল্লিখিত প্রকল্পগুলোর প্রকল্প পরিচালক নিয়োগসংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের আদেশসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র তলব করা হয়েছে। পত্রে রংপুর সিটি করপোরেশনের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের অনুসন্ধানের স্বার্থে এসব কাগজপত্র তলব করা হয়েছে বলে জানানো হয়। এদিকে রসিকের একটি সূত্র জানায়, বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন প্রায় ১৩ বছর ধরে কর্মরত আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে করপোরেশনের টাকা নয়ছয়, নামে-বেনামে টাকা ও রংপুরে অবৈধভাবে ফ্ল্যাট ও প্লটের মালিক হওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। তিনি সিটি করপোরেশনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। গোলজার রহমান আদরকে মামলায় ফাঁসানোর পর তিনি তাঁর সিন্ডিকেটের সদস্য আতাউর জামান বাবুকে দিয়ে মীমাংসার কথা বলে ডেকে নিয়ে র‌্যাবের হাতে ধরিয়ে দেন। জানতে চাইলে আতাউর জামান বাবু অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি গোলজার রহমান ওরফে আদর রহমানকে ডেকেছিলাম অন্য একটি কাজে। তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন বলেন, ‘আদরের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ নেই। তাঁকে কে বা কারা কিভাবে এ ঘটনায় জড়িত করেছে তা আমার জানা নেই।’ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন একজন ক্যামেরাম্যান এই মামলায় একক আসামি হন কিভাবে—এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কৌশলে তা এড়িয়ে যান। দুদকে তাঁর কাগজপত্র তলবের বিষয় জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘দুদক কার্যালয়ে আমাকে তলব করলে আমি কাগজপত্র নিয়ে সাক্ষাৎ করি।’ এদিকে আদরকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে গ্রেপ্তারের ঘটনায় রংপুর ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনসহ রংপুরের সাংবাদিকসমাজ নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁর মুক্তি দাবি করেন। আদর রহমান রংপুর ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের রংপুর শাখার সভাপতি।
Link copied!