বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দোষারোপের রাজনীতি, কার লাভ কার ক্ষতি

প্রকাশিত: ০৩:৩০ এএম, এপ্রিল ১১, ২০২১

দোষারোপের রাজনীতি, কার লাভ কার ক্ষতি

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলছেই। বিশেষ করে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতারা প্রায় প্রতিদিনই পরস্পরকে দুষছেন। একে অন্যকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ নিয়ে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা বলেছেন, করোনাভাইরাস নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কে কার লাভ হচ্ছে? কার ক্ষতি হচ্ছে? এমন বিতর্ক কিছুতেই শোভনীয় নয়। এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিবাদ এড়িয়ে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে। বিপন্ন মানুষকে বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানবতার ডাকে সাড়া দিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। গত ৩ এপ্রিল বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠক থেকে বলা হয়, মাঠে আন্দোলনরত হেফাজতে ইসলামকে ঘরে নিতেই লকডাউন দেওয়া হয়েছে। সরকারের চরম উদাসীনতা, অব্যবস্থাপনা, অযোগ্যতা এবং করোনা নিয়ে দুর্নীতির কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এর জবাবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে দলীয় আলোচনায় নেতারা বলেছেন, হেফাজত মোকাবিলায় লকডাউন দেওয়ার বিষয়টি বিএনপির আজগুবি অভিযোগ। গত বছর তো হেফাজত ইস্যু ছিল না। তখন তো লকডাউন দেওয়া হয়েছিল। করোনা মোকাবিলায় দুনিয়াজুড়েই লকডাউন দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশেও সেটা হচ্ছে। করোনাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বিতর্কের পুরোভাগে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দুই নেতাই প্রায় প্রতিদিন তাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কড়া সমালোচনা করছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত শুক্রবার বলেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন হাসপাতালে বেড ও আইসিইউ সংকট, করোনা পরীক্ষার অপ্রতুলতাসহ যে দুরবস্থা চলছে, তার জন্য সরকারের ব্যর্থতা, উদাসীনতা, সমন্বয়হীনতা এবং অব্যবস্থাপনা দায়ী। এখন মানুষের জীবন ও জীবিকাকে রক্ষা করা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে হার্ড ইমিউনিটির মধ্যে আনতে হলে কমপক্ষে সাড়ে ১২ কোটি মানুষকে টিকা দিতে হবে। কিন্তু এই পরিমাণ টিকার সংস্থান এখনও হয়নি। এর জবাবে ওবায়দুল কাদের শনিবার বলেছেন, বিএনপির উস্কানিতেই অনেকে স্বাস্থ্যবিধির প্রতি উদাসীনতা দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে। তারা লকডাউন নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। করোনার টিকা নিয়েও অপরাজনীতি করছে। তিনি জানতে চেয়েছেন, সমালোচনার তীর ছোড়া ও মিথ্যাচারের বিষবাষ্প ছড়ানো ছাড়া বিএনপি করোনাকালে জনকল্যাণে কী করেছে? তারা তো অপকৌশলের মাধ্যমে করোনাবিরোধী সম্মুখসারির যোদ্ধাদের মনোবলে চিড় ধরাতে চাইছে। কিন্তু মানুষ তাদের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। বিএনপি মহাসচিব গত শুক্রবার করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে সর্বদলীয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া এই বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাই রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তিসহ সব স্তরের মানুষকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে। মানুষকে বাঁচাতে হবে। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই সংকট মোকাবিলার উদ্যোগ নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, করোনাভাইরাস কোনো রাজনৈতিক সমস্যা নয়। দেশে করোনাবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি রয়েছে। সরকার বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শক কমিটির মতামত এবং সুপারিশের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। এই ক্ষেত্রে সর্বদলীয় বিষয়ের চেয়ে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতামতই বেশি জরুরি। তা ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশেই সংক্রমণ রোধ কিংবা চিকিৎসায় সর্বদলীয় কমিটি গঠনের নজির নেই। সরকারের বিরুদ্ধে করোনা মোকাবিলার পরিবর্তে বিএনপির নেতাকর্মীদের হয়রানির অভিযোগ এনেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, সরকার মহামারি করোনা মোকাবিলা করতে চাইছে না। তারা মিথ্যা মামলা দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের দমন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তার দৃষ্টিতে, সরকারের উদাসীনতা ও ব্যর্থতায় বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। একই দিন ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি করোনার চেয়েও ভয়াবহ ভাইরাসে আক্রান্ত। যার লক্ষণ নেতিবাচকতা, মিথ্যাচার, ষড়যন্ত্র আর আগুনসন্ত্রাস। আসলে বিএনপির এখন রাজনৈতিক আইসোলেশন দরকার। তিনি দাবি করেন, করোনা মোকাবিলায় সরকার সমন্বিতভাবে কাজ করছে। বিএনপির বক্তব্য প্রমাণ করছে তাদের লেজেগোবরে দশা। করোনা মহামারির সময়ে তারা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে সরকার হটানোর নামে ধান ভানতে শিবের গীত গাইছে। গত বুধবার বিএনপির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সরকারের অব্যবস্থাপনায় মাঠপর্যায়ে লকডাউন কার্যকর হচ্ছে না। সরকারের দ্বিধাগ্রস্ত সিদ্ধান্ত ও সমন্বয়হীনতায় জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারাও দ্বিধাগ্রস্ত। সরকারের কার্যকর উদ্যোগও নেই। যার কারণে দেশে সংক্রমণের হার বেড়েই যাচ্ছে। জবাবে গত শুক্রবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যর্থ হয়ে লন্ডনের নেতৃত্বকে খুশি করতে এবং কর্মীদের রোষানল থেকে বাঁচতে বিএনপি আইসোলেশনে থেকে হাঁকডাক ছাড়ছে। তাদের এ সব হুমকি-ধমকি আষাঢ়ের তর্জন-গর্জনেই সার। তিনি আরও বলেছেন, যখন যে ইস্যু সামনে আসে, সেটা নিয়েই বিএনপি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা করে। কিন্তু পরাশ্রয়ী আন্দোলন ও গোপন ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় আরোহণের দিন শেষ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পরের দোষারোপের বিষয়টি দেশ-জাতির জন্য সুখকর হচ্ছে না বলে মনে করছেন। তাদের ভাষায়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পারস্পরিক বিদ্বেষ বরং বাড়ছেই। শেষ পর্যন্ত করোনা নিয়েও তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে রাজনীতি করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীতে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে এসেছে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে সব ধরনের বিভেদ ভুলে যেতে হবে। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক মত ও আদর্শগত পার্থক্য থাকবেই। কিন্তু ভয়াল করোনা সংকট মোকাবিলায় সবাইকে অবশ্যই এক হতে হবে। মানুষকে বাঁচাতে হবে। মানবতার ডাকে সাড়া দিতে হবে। এ জন্য মত ও পথের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। একে অন্যকে সহযোগিতা করতে হবে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্যাহও করোনা নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের বাদানুবাদকে ভালো দৃষ্টিতে দেখছেন না। তিনি বলেন, মুখোমুখি রাজনীতির কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরকে সহ্য করতে পারে না। তাই বলে 'বিএনপি করোনার চাইতেও ভয়ংকর' এমন উপমা কেন আসবে? করোনা পরিস্থিতিতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করা উচিত উল্লেখ করে ড. মাহবুব উল্যাহ বলেন, করোনা সমস্যার শুরুতেই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে পরামর্শ নেওয়া উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রীর। সেটা হয়নি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, রাজনীতির সংস্কৃতিতে দোষারোপের চর্চা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময়েও দোষারোপের ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এমন ঘটনায় জাতি মর্মাহত হয়েছে। 'করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবার সহযোগিতা দরকার। আর বিরোধিতার নামে বিরোধিতা করাই বিরোধী দলের একমাত্র কাজ নয়। তাই ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা না করে তাদের গঠনমূলক ভূমিকা রাখা উচিত। সরকারকে সহযোগিতা করা উচিত,' বলেন ড. হারুন-অর-রশিদ। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সবার জন্যই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস একটি অদৃশ্য শত্রু। এটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি চেনে না। অথচ এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ধরনের হাস্যাস্পদ তর্ক হচ্ছে। কিন্তু করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এটা কিছুতেই কাম্য নয়। পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করলে করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।  
Link copied!