বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নগরে গার্ডার আতঙ্ক

প্রকাশিত: ১২:৫৫ পিএম, আগস্ট ১৭, ২০২২

নগরে গার্ডার আতঙ্ক

উত্তরায় সোমবার গার্ডার পড়ে প্রাইভেটকারের ৫ আরোহী নিহত হওয়ার পর রাজধানীবাসী এখন আতঙ্কে ভুগছে। বিআরটি ও মেট্রোরেল প্রজেক্টের আশপাশ দিয়ে চলাচলের সময় মানুষের চোখে-মুখে ফুটে উঠছে গার্ডার দুর্ঘটনার শঙ্কা। উত্তরায় গার্ডারচাপায় একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হওয়ার পর থেকে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটিও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে। এ ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা হলেও গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কাউকে আটকের তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেনি পুলিশ। উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মোহাম্মদ মোহসীন জানান, এ ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে ওই ক্রেনচালকের নাম আলামিন হাসান হৃদয় (২৭) বলে আমরা জানতে পেরেছি। আশা করছি, শিগগিরই তাকে গ্রেফতার করতে পারব। এ ছাড়া চীনা কোম্পানিটির কার কী দায় রয়েছে সেটিও তদন্ত করে বের করছি। এদিকে দুর্ঘটনার পর থেকে অভিযোগের আঙুল উঠেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চীনের জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ও গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের বিরুদ্ধে। এলাকার পথচারীরা জানায়, উত্তরার রাস্তায় বিআরটি প্রকল্পের কাজ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এ প্রকল্পে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী ব্যবহার করেনি। খুব ঝুঁকিপূর্ণ দুয়েক জায়গায় শুধু একটি লাল কাপড় দেওয়া হয় মাঝেমধ্যে। কেবল তা-ই নয়, বিআরটি প্রকল্পের অন্য স্পটগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে তাদের গাফিলতি ও নিরাপত্তাহীনতার চিত্র। বিশেষ করে উত্তরার হাউস বিল্ডিং, আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গীর বাটাগেট, চেরাগ আলী, গাজীপুরা বাসস্ট্যান্ড গিয়ে স্থানীয়দের কাছে থেকে এই নির্মাণকাজ নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া গেছে। উত্তরার জসীম উদ্দীন এলাকা থেকে ধানমন্ডিতে অফিস করতে আসা সাজ্জাদ আলম বলেন, কাজ শুরু করার কিছুদিন পর থেকেই বিআরটি প্রকল্পের দায়িত্বরতরা খেয়াল-খুশিমতো কাজ করছিলেন। সম্প্রতি তাদের দায়িত্বহীনতার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এই পথ ধরে চলাচলের সময়ে আমরা আতঙ্কে থাকতাম। আর এখনও মহা-আতঙ্কে আছি। এর আগেও কাজ চলাকালে প্রায়ই ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটত, যা কখনই এমন পড় মেগা প্রজেক্টের দায়িত্বশীলদের কাছে আশা করা যায় না। আমরা এসব দুর্ঘটনার হোতাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রকল্পে সরাসরি কাজ করা এবং তদারকির দায়িত্বশীলরা যদি নিরাপত্তার বিষয়ে কঠোর থাকতেন তা হলে শিশুসহ পাঁচজনের প্রাণ অকালে ঝরে যেত না। প্রকল্পে অব্যবস্থাপনা, চীনা নাগরিকসহ আটক ৪ : এদিকে এই প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট দুই চীনা নাগরিকসহ ৪ জনকে ঘটনাস্থল থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করার গুঞ্জন উঠেছে বিভিন্ন মাধ্যমে। তবে এর সত্যতা নিশ্চিত করেনি পুলিশ। এ বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি বলেন, আমরা কাউকে আটক করিনি। তকে অন্য কোনো সংস্থা করল কি না জানি না। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ওই দুর্ঘটনাস্থলে ভারী গার্ডার সরানোর কোনো যন্ত্র ফায়ার সার্ভিসের কাছে ছিল না। এ জন্য মেট্রোরেল প্রকল্পে ব্যবহৃত ১৫০ টনের রেকার আনার কথা থাকলেও সেটি ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ৫ ঘণ্টা পর। ততক্ষণে উদ্ধারকাজ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। পরে মেট্রোরেলের ক্রেনটি দিয়ে গার্ডারটি রাস্তা থেকে সরানো হয়েছিল। এদিকে যে ক্রেন দিয়ে এই গার্ডারটি সরানো হচ্ছিল সেটি এত ভারী গার্ডার সরানোর মতো ধারণ ক্ষমতা রাখে কি না, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দায় কার : নিরাপত্তাহীনতা ও গাফিলতির অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সফিকুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, অভিযোগ সঠিক নয়। কাজ করার সময়ে আমাদের নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল। যে গার্ডারটি তোলা হচ্ছিল সেটির ওজন ছিল ৮০ টন। অন্যান্য দিন একই ক্রেন দিয়ে কাজ করা হতো। ৮০ টনেরও বেশি ওজন তোলার সক্ষমতা রয়েছে আমাদের ক্রেনের। গার্ডার তোলার সময়ে ক্রেন হেলে পড়ায় নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে এসে গার্ডার প্রাইভেটকারের ওপর পড়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ‘অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, সেখানে যে ক্রেন দিয়ে বক্সগার্ডার তোলা হচ্ছিল নিশ্চয়ই সেটির যথাযথ সক্ষমতা ছিল না। অর্থাৎ ওই গার্ডার এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিতে অন্তত ১০০ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ক্রেনের প্রয়োজন হওয়ার কথা। কিন্তু ওখানে যে ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে সেটির ধারণক্ষমতা এতটা ছিল না বা যান্ত্রিক ত্রুটিও হয়েছে কি না সেটি দেখার বিষয়। তিনি আরও বলে, সাধারণত কোনো উন্নয়নকাজে এ ধরনের গার্ডার বসানোর কাজ যখন চলে, তখন ওই সড়কটি বন্ধ রাখা হয় এবং সাময়িক চলাচলের আরেকটি বিকল্প পথ তৈরি করা হয়। কিন্তু সেখানে এমনটি ছিল না। অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, এই দুর্ঘটনার দায় কেউ এড়াতে পারেন না। এর দায়, ওখানকার সিটি করপোরেশন মেয়র, সড়ক মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদে দায়িত্বশীল থেকে শুরু করে প্রকল্পের দায়িত্বশীলরা, প্রকল্প তদারকি যাদের করার কথা ছিল তারা এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কেউই এড়াতে পারেন না। আমি মনে করি, সংশ্লিষ্ট মামলায় তাদেরকে আসামি করা হোক। তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত তৈরি করা হোক। বড় ধরনের জরিমানা করা হোক। এর ফলে কেউই যেন ভবিষ্যতে নাগরিক নিরাপত্তার প্রশ্নে গাফিলতি না করার দুঃসাহস দেখায়। ঢাকা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড প্রকল্পের চীনা ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোনোভাবেই কমপ্লায়েন্স (নিরাপত্তা ব্যবস্থা) পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখানে দুটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তারা দুটি চাইনিজ প্রতিষ্ঠান। আমরা এর আগেও জেনেছি, তারা লোকবল কম রেখে, ইকুইপমেন্ট কম ব্যবহার করে কাজটা শুধু রানিং রাখে। কিন্তু ওই রকম স্পিড থাকে না। কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রেও একই কথা। অন্যদিকে এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আক্তার বলেন, রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার পড়ে প্রাইভেটকারের পাঁচ যাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনের (সিজিজিসি) দায় আছে। তারা নিরাপত্তার বিষয়টি বারবার লঙ্ঘন করেছে। এ বিষয়ে ঢাকার চীনা দূতাবাসকে জানানো হবে। আমি এককথায় বলতে চাই, দায়িত্বশীল কেউ দায় এড়ানোর প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশের নাগরিকদের মূল্যবান জীবন চলে গেছে, এক্ষেত্রে আমরা কোনোরকম কম্প্রোমাইজ করতে চাই না। ঘটনার পর দিন গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। মেয়র আসার খবরে সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন পুলিশ, ডিএনসিসি কর্মকর্তারা। আরও উপস্থিত ছিলেন উত্তরা এলাকায় চলমান বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কর্মকর্তারাও। বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে যান মেয়র আতিকুল। দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছেই তিনি বিআরটি কর্মকর্তাদের বকাঝকা শুরু করেন। হুঁশিয়ারি দেন যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক না করা পর্যন্ত এই এলাকায় বিআরটির সব কাজ বন্ধ থাকবে। উপস্থিত বিআরটি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আতিকুল ইসলাম বলেন, যেখানে কাজ করবেন সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আপনারা করবেন না? এসব কাজ তো সাধারণ জনগণের জন্যই। কিন্তু সেখানে যদি তাদেরই নিরাপত্তা না থাকে তা হলে এই কাজ করে লাভ কি? সেফটি ফার্স্ট এই কথাটা কি আপনারা জানেন না? আগে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক করবেন এরপর পরবর্তী কাজ করতে পারবেন। আমি এখানে আপনাদের কাজ করতে দেব না, ‘আই উইল নট।’ কোনোভাবেই আপনারা এখানে কাজ করতে পারবেন না। আপনারা সব কাজ ক্লোজ করে দেন। এখানে সবাই উপস্থিত আছেন। আপনারা আমার সঙ্গে বসেন। আগে নিরাপত্তার বিষয়টি আমার কাছে নিশ্চিত করবেন। ওয়ার্ক সেফটি, প্লেস সেফটি, পাবলিক সেফটির বিষয়টি আমার কাছে নিশ্চিত করে এরপর পরবর্তী কাজ। নির্মাণাধীন প্রকল্পে যত দুর্ঘটনা : এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সর্বশেষ উত্তরায় গার্ডার দুর্ঘটনায় ৫ জন নিহত হয়েছে। বিআরটি প্রকল্পে দুর্ঘটনা আগেও ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে গত মাসে গাজীপুরে একই প্রকল্পের ‘লঞ্চিং গার্ডার’ চাপায় এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন। আহত হন আরও দুজন। ফ্লাইওভারের কাজ করার সময় লঞ্চিং গার্ডারটি গাড়িতে উঠানোর সময় সেটি কাত হয়ে পড়ে ওই হতাহতের ঘটনা ঘটে। গত বছরের ১৪ মার্চ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার পড়ে চারজন আহত হন। তাদের মধ্যে দুজন চীনের নাগরিক ছিলেন। ক্রেনের মাধ্যমে গার্ডারটি তুলে ফ্লাইওভারে স্থাপনের সময় সেটি ছিটকে পড়ে। এর আগে উত্তরার আবদুল্লাহপুরে গভীর রাতে এ প্রকল্পের পিয়ার ক্যাপ নামে গার্ডারের একটি অংশ ধসে পড়ে। তবে সেখানে কেউ হতাহত হননি। কেবল বিআরটি প্রকল্পে নয়, মেট্রোরেল প্রকল্পের গাফিলতিতেও পথচারী নিহতের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের ৩০ মে রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বর সড়কে নির্মাণাধীন মেট্রোরেল প্রকল্পের ইট ওপর থেকে পড়ে এ কে এম মাহবুবুর রহমান তালুকদার নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। তিনি মিরপুরের একটি স্বর্ণের দোকানে কাজ করেন। নির্মাণাধীন প্রকল্পে দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ১৩ জন প্রাণ হারানোর ঘটনাটি। ওই বছরের ২৬ নভেম্বর চান্দগাঁও থানায় ২৫ জনকে আসামি করে মামলা হলেও আজও শেষ হয়নি মামলার বিচার কাজ। সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ না হওয়ায় এখনও ঝুলে আছে। এছাড়া চলতি বছর ১৬ জুন সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে নির্মাণাধীন জাদুকাটা সেতুর একটি গার্ডার পিলার ঢলের পানিতে ধসে পড়ার ঘটনা ঘটে। ৭ জুন গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় নির্মাণাধীন একটি সেতুর গার্ডার ধসে পড়ে এবং ২৮ এপ্রিল রাঙামাটি-কাপ্তাই সড়কে নির্মাণাধীন সেতুর গার্ডার ধসে একজন শ্রমিক নিহত হন। উল্লেখ্য, বিআরটির এই প্রকল্পটি ২০১২ সালে একনেক সভায় অনুমোদন পেলেও এর কাজ শুরু হয় ২০১৭ সাল থেকে, যা এখনও চলছে।
Link copied!