বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাম বেচে খাওয়া আত্মীয়স্বজন, এবং আমজনতা

প্রকাশিত: ০৯:২৭ এএম, মে ৯, ২০২২

নাম বেচে খাওয়া আত্মীয়স্বজন, এবং আমজনতা

মুবিন এস খান:কায়েস সাহেবের কাছে কী এমন জিনিস আছে যা আপনার কাছে ছিল না? তার কাছে যেটা ছিল, সেটাকে খাস বাংলায় বলা হয় 'জায়গামতো কানেকশন'। তার মা হচ্ছেন রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজনের স্ত্রী'র ফুপাতো বোন। তাকে ঘটনা জানানোর পর রেলমন্ত্রীর স্ত্রী তড়িঘড়ি পাকশি রেলওয়ে ডিভিশনাল কমার্শিয়াল অফিসার (ডিসিও) নাসির উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করেন। নাসির উদ্দিন নিদারুণ আমলাতান্ত্রিক পটুতার সাথে শফিকুলকে ফোন করে সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত করে দেন। বাংলাদেশের কোনো সরকারি দপ্তরে কখনো কোনো অভিযোগ দায়ের করেছেন?হয়তো এমন হয়েছে যে আপনাকে কোনো মৌলিক সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে যে সেবাটি আপনার পাওয়ার কথা সেটি আপনি পাননি। সেজন্য আপনি চাইলেন বিষয়টি ওপরওয়ালাদের জানাবেন।সবার আগে আপনাকে যেটা নিয়ে ঘাম ছোটাতে হবে সেটা হচ্ছে, ঠিক কোন জায়গায় বা কার কাছে আপনার অভিযোগটি জানাবেন তা খুঁজে বের করা। এরপর যদি আপনি সেই অফিস বা ব্যক্তিটির হদিস পানও, দেখা যাবে আপনার অভিযোগ গ্রহণের আবেদন সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। নয়তো দেখবেন আপনাকে রাজ্যের অজুহাত আর হুজ্জতের কথা শোনানো হবে যেগুলো হয়রানিরই নামান্তর। ধরা যাক, আপনিও বেজায় নাছোড়বান্দা। আপনার ধৈর্যের শেষ নেই, এছাড়া নিজের নাগরিক অধিকারের বিষয়ে একচুলও ছাড় দেওয়ার পাত্র আপনি নন। এসবের গুণে শেষ পর্যন্ত আপনি আপনার অভিযোগটি দাখিল করতে সফল হলেন।ভাবছেন, জিতে গেলেন বুঝি? আপনার ওই অভিযোগের ফলাফল পাওয়ার জন্য শুভকামনা জানানো ছাড়া আর কিছু করার নেই। দিন, মাস, বছরের পর বছর পার হয়ে যাবে, আপনার বাচ্চাকাচ্চারা বড় হয়ে যাবে, আপনার মা-বাবা ধরাধাম ছেড়ে চলে যাবেন, কিন্তু আপনার সেই অভিযোগের ফলাফলের অপেক্ষা 'গডোর জন্য অপেক্ষা'র অনুশীলন হয়ে যাবে।তবে ইমরুল কায়েস নামের এক ভদ্রলোককে এমনতর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি। ঢাকা থেকে ঈশ্বরদী যাওয়ার জন্য গত ৫ মে আরও দুই সঙ্গী নিয়ে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরা উঠে বসেছিলেন তিনি। তাদেরকে যখন বিনা টিকেটে ভ্রমণহেতু টিটিই সাহেব জরিমানা করে বসলেন, তখন তারা বেজায় নাখোশ হলেন। কায়েস ঠিক-ঠিক জানতেন কার কাছে অভিযোগ জানাতে হবে তার মা ইয়াসমিন আক্তার আর তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই টিটিই শফিকুল ইসলাম বরখাস্ত হয়ে যান 'যাত্রীদের সাথে মারমুখী আচরণ করার' জন্য। তো,কায়েস সাহেবের কাছে কী এমন জিনিস আছে যা আপনার কাছে ছিল না? তার কাছে যেটা ছিল, সেটাকে খাস বাংলায় বলা হয় 'জায়গামতো কানেকশন'। তার মা হচ্ছেন রেলমন্ত্রী মো: নুরুল ইসলাম সুজনের স্ত্রী'র ফুপাতো বোন। তাকে ঘটনা জানানোর পর রেলমন্ত্রীর স্ত্রী তড়িঘড়ি পাকশি রেলওয়ে ডিভিশনাল কমার্শিয়াল অফিসার (ডিসিও) নাসির উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করেন। নাসির উদ্দিন নিদারুণ আমলাতান্ত্রিক পটুতার সাথে শফিকুলকে ফোন করে সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত করে দেন। ঘটনাদৃষ্টে মনে হয়, টিকেট চেকারের কথিত খারাপ আচরণ বিষয়ে এক যাত্রীর অভিযোগ শোনামাত্রই ওই রেল কর্মকর্তা খুব দ্রæতই নড়েচড়ে বসেন। রেলমন্ত্রীর আত্মীয় হওয়া সত্বেও বিনা টিকেটের ওই তিন যাত্রীকে এসি বগি থেকে জোর করে নামিয়ে দেওয়া সেই টিকেট চেকারকে অভিযোগের কয়েক মিনিটের মধ্যেই বরখাস্ত করা হয়।সবচেয়ে নির্লজ্জ কোনো অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করতে গেলেও কখনো অবশ্য আপনার ও আমার অভিজ্ঞতা এমনটা হয়নি। আর রেলমন্ত্রীর আত্মীয়ের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক এই ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত (টিকেট চেকার জানিয়েছেন, তিনি কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করেননি, কেবল যাদের টিকেট ছিল না তাদেরকে চলে যেতে অনুরোধ করেছিলেন এবং আমরা বেচারা টিকেট চেকারের কথাতেই বিশ্বাস রাখি) এটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে এদেশে প্রভাবশালীরা কীভাবে রাজত্ব করে, কীভাবে এখানে আমজনতা অবজ্ঞার স্বীকার হয়, কীভাবে লাগামহীন ক্ষমতা মানুষকে ইতরে পরিণত করে এবং তারা আমাদের মতো বাকিদেরকে কীরকম ছোট চোখে দেখে।এ ঘটনার ঠিক বিপরীত চিত্র আমরা দেখতে পাই ব্রিটিশ পুলিশের তাদের প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে লকডাউনের নিয়ম ভঙ্গ করার জন্য জরিমানা করার ক্ষেত্রে। এ ঘটনা থেকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দুটি সমাজের ভিন্নতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।বাংলাদেশে এরকম শতশত কায়েস আছেন যারা চাইলে 'জায়গামতো যোগাযোগ' করে অঙ্গুলিহেলনে 'পাহাড়ও সরিয়ে ফেলতে পারেন'। আর শফিকুলের মতো অসংখ্য মানুষ তাদের এসব কাজের অন্তরায় হয়ে বিপাকে পড়েন। এর বাইরে আরও অসংখ্য মানুষ আছেন যারা এসব ক্ষমতাধারীদের ক্ষমতার প্রভাব সম্পর্কে জানেন বলে তাদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করতেও সাহস করেন না।কিন্তু দেখা গেল শফিকুল একটু ভিন্ন ধাঁচের ছিলেন। তিনি ওই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সাহস তো দেখিয়েছেনই, পাশাপাশি মিডিয়ার সামনেও নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলতে দ্বিধা করেননি। অবশ্য সেটা করার পরে সব তুলকালাম হয়ে গেল। মন্ত্রী সুজন প্রথমে কায়েস ও বাকি দুজনের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকার কথাই অস্বীকার করেন। পরে ইয়াসমিন আক্তার গণমাধ্যমে কথা বলে নিশ্চিত করেন মন্ত্রীর স্ত্রীর সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। রোববার (৮ মে) মন্ত্রী সম্পর্কের কথা স্বীকার করে শফিকুলকে পুনরায় কাজে বহাল করার কথা ঘোষণা দেন। কিন্তু এতকিছুর পর তিনি আবার জানালেন শফিকুলকে বরখাস্ত করার দায়ে নাসির উদ্দিনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। সবমিলিয়ে মনে হচ্ছে বলির পাঁঠা ঠিকই খুঁজে পাওয়া গেল।বিনা টিকেটে রেলভ্রমণ, মন্ত্রীর নাম করে পার পাওয়ার তরিকা, নিজের স্বামীর অধীনে কাজ করা কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে ফোন করে অন্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী আত্মীয়ের কথা বেমালুম অস্বীকার করা; এসব কিছুই যেন দোষের কোনো কাজ নয় বরং নিজের দায়িত্ব পালন করাটা বা ঊর্ধ্বতন কর্তার আদেশ মানাটাই দোষের। টিটিই শফিক বরখাস্ত হওয়ার পর স্বভাবতই দেশের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন, দেশের গণমাধ্যমে ঘটনার খবর প্রকাশ করা হয়। বছরের পর বছর আমরা এ ধরনের ঘটনার খবর কাগজে পড়ছি, দৈনন্দিন জীবনে তাদের কীর্তিকলাপের বৃত্তান্ত জানতে পারছি, এমনকি নিজেদের চর্মচক্ষুতে তাদেরকে দেখার 'সৌভাগ্য'ও হচ্ছে। রেল বা বাস স্টেশনে লাইন ভাঙার মতো ছোট ঘটনা থেকে শুরু করে কোটি টাকার সরকারি চুক্তি বাগিয়ে নেওয়া; জায়গামতো কানেকশনের শক্তি আমাদের নিত্যদিনের জীবনে রাজা বনে গেছে। আপনি কোন কাজে কতটা দক্ষ, কর দেওয়া নাগরিক হিসেবে আপনার অধিকার; এসবের পরোয়া কেউ করে না। আপনার 'মামা' কে সেটাই হচ্ছে আসল কথা। গত শনিবার (৭ মে) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পুরো ঘটনার তদন্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত রেলমন্ত্রীকে সাময়িকভাবে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এটাই সঠিক আহ্বান বলে মনে হয়। মন্ত্রীর পক্ষে প্রথমে কোনো সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করে পরে গাছাড়াভাবে ঘটনার বিষয়ে নিজের অজ্ঞতার দাবি করে পুরো দোষ নাসির উদ্দিনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। এখন যেহেতু মন্ত্রী পুরো ঘটনা জানেন, তাহলে তিনি তার নাম বেচে খাওয়া আত্মীয়দের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? তার স্ত্রী কেন একজন ডিসিওকে আগ বাড়িয়ে ফোন করতে গেলেন? শফিকুলকে নিয়ে গণমাধ্যমের আলোচনা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি যে কোনোভাবে তার 'কর্মফল' ভোগ করবেন না সেটার নিশ্চয়তা কী?এই প্রশ্নগুলোসহ আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর কেবল চুলচেরা তদন্তের মাধ্যমেই দেওয়া সম্ভব। তার আগপর্যন্ত মন্ত্রীর সরে দাঁড়ানোই উত্তম। আর 'জায়গামতো যোগাযোগে'র এই সংস্কৃতির আমাদের সমাজ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে 'মামাবাড়ির আবদার' বানিয়ে ফেলার বিরুদ্ধে কথা বলার এটাই উপযুক্ত সময়। একটি যথাযথ তদন্ত হতে পারে এর প্রথম ধাপ।সুত্র-টিবিসি-মতামত-মুবিন এস খান: সাংবাদিক  
Link copied!