শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নীলা হারুন-এর কবিতা ‘নূহের নৌকা’

প্রকাশিত: ০৪:০০ পিএম, জুন ২২, ২০২০

নীলা হারুন-এর কবিতা ‘নূহের নৌকা’

‘মাছ দু'গা তড়াতড়ি কাট, ঝড় আইলো বইলে। ঝড় আইলে ভাপা মাছ খাওয়া বারইবেনে।’ দাদী কাঁপা হাতে মোটা চাল ধুতে ধুতে তাড়া দেয় ফুফুকে। আজ আমরা বিলের মাছ খাব। হলুদ পেটির জিয়ন বুড়ো কই। সারাদিনের ঝমঝম বৃষ্টির মাঝে, সবুজ হাফপ্যান্ট পরে বাবলু মাছ ধরে এনেছে। টিনের চাল আর বাবলুর চুল বেয়ে পানির ফোঁটা নামে- টপাটপ। মা প্রাণপণে ফুঁ দিয়ে যায় ভেজা চুলায়। চুলাটা ছাগলের মত হাম হাম করে খায় আধভেজা পাতা। পাতা গুলো মায়ের শাড়ি দিয়ে ঢেকে রাখা ছিল। তবু কোমল হয়ে উঠেছে। আজ আমাদের চড়ুইভাতি ঘরের ভেতর। শুনেছি প্রবল এক ঘূর্ণিঝড় আসবে মাঝরাতে। লোকেরা কোথায় কোথায় চলে গেছে! উঁচু উঁচু স্কুলঘরে। কতজন রুগ্ন ভূত হেঁটেছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে। কাদামাখা পথে রিকশা ঠেলাগাড়ি করে নেয়া যাবেনা কিছুই। মানুষ তো নয়ই। বাবা ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে। দাদী আমাদের আধচালা ঘরের দিকে তাকায় একবার, আবার তাকায় মায়ের পেটের দিকে। ‘নয়মাসের পেট নিয়া হাঁটতে পারব না। তোরা যা, আমরা থাকি।’ আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে গেলাম না। ফুফু আছাড় মেরে মেরে কানকো কাটতে লাগলো মাছের। বাবলু ভেজা সবুজ প্যান্ট পড়েই মায়ের আঁচলে মাথা ঝাড়তে লাগল। আমি আগের মতই দূরের সরকারী স্কুলের পড়া পড়ি- ‘অর্থই অনর্থের মূল।’ বাবা দরূদ জপতে থাকে। তার পুরনো সুতি শার্টের পকেট বড় স্বচ্ছ। একটি পয়সার ভারেও সেটি নুয়ে পড়ে। ‘পেট ভইরা ভাত খাইয়া ঘুমাইয়া পড়। ঝড় আইলে উপর দিয়া যাইব গিয়া টের পাইতি না।’ দাদীর ভরসায় আমরা ঘরের ভেতর চড়ুইভাতির ভাপা বুড়ো কই, ফেনাভাত, বন্য লেবু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝরাতে প্রবল ঝড় এল। ঝড়ের শোর ছাপিয়ে আমার কানে এল মায়ের কান্না। প্রসববেদনার যন্ত্রনাকে এড়িয়ে পাশ ফিরে শুই। খুলে যায় জানালার কপাট। যেন আমি পুকুরে শুয়ে আছি। দেখি হাওয়াই সুফি যাচ্ছে নেচে নেচে। উঠান ভেসে যাচ্ছে শাপলা ফুল আর কচুরিপানায়। বাবাকে ঘুম ঘুম গলায় বলি, ‘পরের মেলায় একটা নূহের নৌকা কিন্যা দিও!’
Link copied!