শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ন্যের সম্পত্তি দখলে ‘দুর্নিবার’ রাজারবাগ পির

প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২১

ন্যের সম্পত্তি দখলে ‘দুর্নিবার’ রাজারবাগ পির

ঢাকার শান্তিবাগের বাসিন্দা একরামুল আহসান কাঞ্চন। দীর্ঘ প্রবাসজীবনের পর দেশে ফেরেন ১৯৯৫ সালে। নারায়ণগঞ্জের পৈতৃক জায়গায় শুরু করেন ক্ষুদ্র ব্যবসা। তবে ২০১০ সাল থেকে তার জীবন আটকে যায় জেলখানায়। ১১ বছরে ৪৯টি মামলায় সাড়ে আট বছর বিভিন্ন মেয়াদে জেল খাটেন। এর মধ্যে বিভিন্ন জেলায় হওয়া ৩৫টি মামলায় খালাস পেয়েছেন। এখনও চলছে ১৪টি। বিনা দোষে মামলার শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলে হাইকোর্টে রিট করেন কাঞ্চন। তার আবেদনের শুনানি নিয়ে সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। এরপর সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে বিস্মিত আদালত। সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, জায়গা-জমি দখলের জন্য রাজারবাগ দরবার শরিফের পির দিল্লুর রহমান মুরিদদের দিয়ে নিরীহ কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলা দিয়েছেন। এই প্রতিবেদন দেখে বিস্মিত আদালত রোববার মন্তব্য করে, ‘পির সাহেবের কাণ্ড দেখেন। জায়গা-জমি দখলের জন্য পির সাহেবরা তাদের অনুসারী-মুরিদ দিয়ে কী করে দেখেন। যেখানে একটা মামলা দিলেই একজন মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায়, সেখানে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এত মামলা! এটা তো সিরিয়াস ব্যাপার।’ ঘটনার শিকার ব্যক্তি, তদন্ত সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজারবাগ দরবার শরিফের পির দিল্লুর রহমানের জালিয়াতি ও প্রতিহিংসার ভয়াবহ তথ্য। যেভাবে দুর্গতির শুরু একরামুল আহসান কাঞ্চন জানান, তার বাবা মারা যাওয়ার পর মা, বড় ভাই ও ছোট বোন রাজারবাগের পির দিল্লুর রহমানের মুরিদ হন। তখন থেকেই তারা পিরের কথা মতো চলতেন। আর কাঞ্চনের দুর্গতির শুরু সেখান থেকেই। কাঞ্চন তখন ছিলেন জাপানে। সেখান থেকে পরিবারের জন্য একটি গাড়ি পাঠিয়েছিলেন। তবে মা সেটি পির দিল্লুরকে দিয়ে দেন। কাঞ্চন বলেন, ‘১৯৯৫ সালে দেশে ফিরে ব্যবসা শুরু করি। দেশে আসার পর আমাকে ও আমার ছোট ভাইকেও পিরের মুরিদ হওয়ার জন্য মা ও বড় ভাই চাপ দিতেন।’ তবে পির-মুরিদের বিষয়গুলো পছন্দ করতেন না কাঞ্চন ও তার ছোট ভাই কামরুল আহসান বাদল। কামরুল পেশায় চিকিৎসক। এর মধ্যে স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে পিরকে দায়িত্ব দেন কাঞ্চনের মা। তার ধারণা ছিল, পিরের হাতে বাটোয়ারা করলে ‘বরকত’ হবে। তবে দলিলের ফটোকপি পেয়ে সম্পত্তির পরিমাণ জেনে যান পির দিল্লুর রহমান। শুরু করেন কৌশলে সেগুলো দখলের চেষ্টা। কাঞ্চন জানান, পির কথার ফাঁদে ফেলেন তার মাকে। তাকে এমনভাবে প্রভাবিত করা হয় যে, পিরের মেয়ের বিয়ের সময় জমি বিক্রি করে ১২০ ভরি স্বর্ণের মুকুট উপহার দেন তিনি। এরপর কাঞ্চনের মায়ের কাছ থেকে মাদ্রাসার জন্য জমি লিখিয়ে নেন পির। কাঞ্চন ও তার ছোট ভাই কামরুল এসবে বাধা দিতে শুরু করলে তাদের ওপর নেমে আসে একের পর এক মামলার খড়্গ। কাঞ্চন বলেন, ‘মাকে আবার ব্রেইন ওয়াশ করে আমাদের বাড়ি থেকে পিরের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন থেকে আমার মা সেখানেই থাকেন। শান্তিবাগের তিনতলা বাড়ির একতলা-দোতলায় আমি আর আমার ছোট ভাই থাকতাম, তিন তলায় আমার বড় ভাই থাকত। এরপর ২০১০ সাল থেকে আমাকে ৪৯টি ও আমার ছোট ভাইকে ২২টি মামলা দিয়ে ধারাবাহিকভাবে জেলে রাখা হয়।’ তিনি বলেন, ‘এমন কোনো ধারা নেই যাতে আমার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়নি। মাদক, মানব পাচার, হত্যা, ধর্ষণ, জমিসংক্রান্ত মামলা, ডাকাতি, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন- এসব ধারায় আমার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়।’ ঢাকাসহ সাত থেকে আটটি জেলায় মামলা হয়েছে দুজনের বিরুদ্ধে। এক মামলায় জামিন পেলে আরেক মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। এভাবে চলে ১১ বছর। একপর্যায়ে হয়রানি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় নিজের জমি ও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ডায়িং কারখানা পিরের মাদ্রাসার নামে লিখে দেন কাঞ্চন। এতেও শেষ হয়নি হয়রানি। এখন পির চাইছেন তার ৪০০ শতাংশ জমি। এরপর বাধ্য হয়ে কাঞ্চন হাইকোর্টে যান। পিরের মুরিদ বড় ভাইয়ের উল্টো অভিযোগ কাঞ্চনের মা পিরের দরবার শরিফে থাকায় তার সঙ্গে যোগযোগ করা যায়নি। তবে কথা হয় কাঞ্চনের বড় ভাই আকতার-ই-কামালের সঙ্গে। তিনি পিরের বিরুদ্ধে কাঞ্চনের সব অভিযোগ নাকচ করে বলেন, ‘ওরে (কাঞ্চনকে) বলেন পির যে আমাদের জায়গা নিয়েছে তার প্রমাণ দিতে। তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ। আমার মা আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে মাদ্রাসার নামে একটু জমি দান করেছে। সেটা ও ভালোভাবে নিতে পারেনি। ও লোভে পড়ে গেছে। ও আমাদের সব সম্পদ চায়। সম্পদের লোভে পিরের সাহেবের নামে উল্টাপাল্টা কথা বলছে।’ আকতার বলেন, ‘সে (কাঞ্চন) আমার নামে আমার মায়ের নামে মামলা দিয়েছে। অন্য একজন মহিলাকে মা বানিয়ে জাল সই দিয়ে মায়ের সব জমির হেবা দলিল করেছে। সেটা নিয়ে আমার মা পাল্টা মামলা করেছে। আমিও ওর নামে মামলা করেছি। কারণ, সম্পদের জন্য কাঞ্চন সন্ত্রাসী দিয়ে আমার ছেলেকে ছুরিকাঘাত করিয়েছে। ও আমাদের পরিবারকে শেষ করে দিয়েছে। ‘ও অনেক আগে থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। ও মার্ডার কেস ও মেয়েলি মামলার আসামি। লোভ তাকে শেষ করে দিয়েছে।’ কিছুই বলবেন না পির অভিযোগের বিষয়ে রাজারবাগ দরবার শরিফের পির দিল্লুর রহমানের বক্তব্য জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন না বলে জানানো হয় দরবার শরিফ থেকে। অন্যদিকে পিরের মুখপাত্র মাহবুব আলম আরিফ সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এগুলো পির সাহেবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তিনি কোনোভাবেই কোনো মামলার সঙ্গে জড়িত নন। কোনো মামলার বাদী পির সাহেব নন। তাহলে এখানে তার নাম কেন আসবে? মামলার বাদী ও সাক্ষীদের সঙ্গে পিরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিআইডির প্রতিবেদনে অনেক ভুল আছে। পিরের মুরিদদের সঙ্গে কাঞ্চন শত্রুতা করত, তাদের ওপর হামলা-মারধর করত। তাই তারা মামলা করেছে। এখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পিরকে জড়ানো হচ্ছে।’ যা আছে সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনে মামলার জাল থেকে মুক্তি পেতে উচ্চ আদালতে রিট করেন একরামুল আহসান কাঞ্চন। তখন আদালত কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলা তদন্ত করে সিআইডিকে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয়। সেই প্রতিবেদনের অনুলিপি পেয়েছে নিউজবাংলা। সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ সুপার রতন কৃষ্ণ নাথের করা তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘একরামুল আহসান কাঞ্চনের তিন ভাই এবং এক বোন। ১৯৯৫ সালে তার বাবা ডা. আনোয়ারুল্লাহ মারা যান। রাজারবাগ দরবার শরিফের পেছনে ৩ শতাংশ জমির ওপর তিনতলা পৈতৃক বাড়ি তাদের। বাবার মৃত্যুর পর কাঞ্চনের বড় ভাই আক্তার-ই-কামাল, মা কোমরের নেহার ও বোন ফাতেমা আক্তার পির দিল্লুর রহমানের মুরিদ হন। তবে রিট আবেদনকারী ও তার অপর ভাই ডা. কামরুল আহসান বাদলকে বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করেও ওই পিরের মুরিদ করা যায়নি। ‘এরই মধ্যে একরামুল আহসান কাঞ্চনের মা, ভাই ও বোনের কাছ থেকে তাদের পৈতৃক জমির অধিকাংশই পিরের দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করা হয়। আর একরামুল আহসান কাঞ্চন ও তার ভাইয়ের অংশটুকু পির এবং তার দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করার জন্য পির দিল্লুর এবং তার অনুসারীরা বিভিন্নভাবে চাপ দেন।’ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সম্পত্তি হস্তান্তর না করায় পির দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীদের সঙ্গে একরামুল আহসান কাঞ্চনের শত্রুতা সৃষ্টি হয়। সে শত্রুতার কারণেই একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় হয়রানিমূলক মামলা করা হয়। পির দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীরা হীনস্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টা করেছেন মর্মে তদন্তকালে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে।’ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় মোট ৪৯টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে ৩৫টিতে তিনি খালাস পেয়েছেন। বর্তমানে ১৪টি মামলা আদালতে বিচারাধীন। এসব মামলার বাদী ও সাক্ষীদের বিষয়েও তদন্ত করে সিআইডি। হয়রানিমূলক মামলাগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ তিনজন ব্যক্তির নাম ও ভূমিকা সিআইডি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন রাজারবাগ দরবার শরিফের পিরের মোহাম্মদীয়া ট্রি প্লানটেশন প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা শাখারুল কবির, পিরের আবাসন কোম্পানি সাইয়্যেদুল কাওমাইন প্রোপার্টিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুকুর রহমান, পিরের মোহাম্মদীয়া জামিয়া শরিফ মাদ্রাসার সভাপতি মো. মফিজুর রহমান। সিআইডির অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, অধিকাংশ মামলার বাদী, সাক্ষী ও ভুক্তভোগী কোনো না কোনোভাবে রাজারবাগ দরবার শরিফ ও পিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মানবাধিকার কমিশনের তদন্তেও উঠে এসেছে পিরের মামলার বিষয় পিরের মামলাবাজ সিন্ডিকেট নিয়ে গত বছর তদন্ত কমিশন করেছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। তাদের ২৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার তথ্য রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজারবাগ দরবার শরিফের পির দিল্লুর রহমান এবং তার অনুসারীরা দরবার শরিফের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য নিরীহ জনসাধারণের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করছে। প্রতিবেদনে কেস স্টাডি হিসেবে একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। সূত্র: নিউজবাংলা
Link copied!