মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

পকেট মেরে লোপাট ১৫৭০ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ১১:৩২ এএম, জুলাই ৩, ২০২১

পকেট মেরে লোপাট ১৫৭০ কোটি টাকা

দেশে চালের উৎপাদন, সরবরাহ, আমদানি ও মজুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক-যা নিশ্চিত করেছে খোদ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। সরকারি এই সংস্থাটির হিসাবে দেশে চালের চাহিদা মিটিয়ে গত ৩০ জুন পর্যন্ত প্রায় ৩০ লাখ টন উদ্বৃত্ত রয়েছে। এছাড়া মিল পর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি আড়ত ও খুচরা বাজারেও নেই চালের ঘাটতি। এরপরও গত ১৩ মে বিভিন্ন চালের দাম কেজিতে গড়ে ৫ টাকা বেড়েছে। ২৫ জুন পর্যন্ত এই বাড়তি দরেই বিক্রি হয়। ২৬ জুন কেজিতে গড়ে ২ টাকা কমে ৩০ জুন পর্যন্ত ৩ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছে। ব্রির হিসাব অনুযায়ী, ১৬.৭০ কোটি মানুষের দিনে চালের চাহিদা ৬.৭৬ কোটি কেজি। সেই অনুযায়ী, ১৩ মে থেকে গত ৩০ জুন এই ৪৯ দিনে চালের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট থেকে চাল সিন্ডিকেট লোপাট করেছে প্রায় ১ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টির জন্য মূলত মিলারই জড়িত বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, মিলাররাই কারসাজি করে বাড়তি দামে চাল বিক্রি করায় পাইকারি ও খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। যা প্রতিবছরই হয়। এবারও তাই হয়েছে। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা মিলারদের সঙ্গে দামের সমন্বয় করেছে। তদারকি করে বাজারমূল্য সহনীয় রাখতে হবে। জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না হওয়ার কারণেই মূলত একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আর একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নানা অজুহাতে ভোক্তাদের পকেট থেকে প্রতিবছর নির্বিঘ্নে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। যদিও মিলাররা বলছেন, ধানের উৎপাদন বাড়লেও কৃষকরা ধান বিক্রি করছেন না। তারা গোলায় ভরে রাখছেন। বেশি দাম পেলে পরে বিক্রি করবেন। এ কারণে ধানের সরবরাহ কমেছে। বেড়েছে দাম। বাধ্য হয়ে মিলারদেরও বেশি দামে ধান কিনতে হচ্ছে। এতে বেড়েছে চালের দামও। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বাজারে চালের কোনো ঘাটতি নেই। বাজার ভরা চাল। তবু মিলাররা দাম বাড়াচ্ছেন। ফলে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দামও বাড়ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেছেন, পাইকারি বাজারে দাম ও পরিবহণ ভাড়া বৃদ্ধির কারণে দাম বেড়েছে। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ৫ এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধ আরোপ করার পর পরিবহণ ভাড়া যেমন বেড়েছে, তেমনি সরবরাহও কমেছে। মিল পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৩ মে থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত ৫০ কেজির প্রতি বস্তা মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৭০০ টাকা। যা ১২ মে পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৫০০ টাকা। সেক্ষেত্রে দেখা গেছে, ওই সময়ে মিল পর্যায়ে বস্তাপ্রতি চালের দাম সর্বোচ্চ ২০০ টাকা বেড়েছে। তখন রাজধানীর পাইকারি আড়ত ঘুরে এবং বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বস্তা মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৮০০ টাকা, যা আগে বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৬০০ টাকায়। তবে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, গত বছর একই সময়ে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৫২-৬২ টাকা। যা বর্তমানে কেজিতে ৫৫-৬৫ টাকা। জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সব সময় নানা অজুহাতে অসাধুরা চালের দাম বাড়ায়। এবারও তাই হয়েছে। তবে এই সুযোগে ভোক্তার পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অসাধুরা। দাম কমাতে বাজার তদারকি সংস্থাগুলোকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। কৃষক পর্যায় থেকে সরাসরি চাল নিয়ে সরকারি মজুত বাড়াতে হবে। আমদানি করে চালের সরবরাহ বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে অসাধুরা সুযোগ পাবে না। পাশাপাশি কঠোর তদারকির মাধ্যমে দাম ভোক্তা পর্যায়ে সহনীয় করতে হবে। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে মাথাপিছু দৈনিক চালের চাহিদা গড়ে ৪০৫ গ্রাম। দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৭০ লাখ ধরে এই চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে। এ হিসাবে প্রতিদিনের চাহিদা ৬ কোটি ৭৬ লাখ কেজি। দেশে বিভিন্ন চালের মধ্যে মোটা, মিনিকেট ও স্বর্ণা চালের চাহিদাই বেশি। এর মধ্যে মিনিকেটের ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি। আলোচ্য ৪৯ দিনে প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে গড়ে ৩ থেকে ৫ টাকা। গত ১২ মে প্রতি কেজি মিনিকেটের দাম ৬০ টাকা। ১৩ মে এর দাম এক লাফে ৫ টাকা বেড়ে হয় ৬৫ টাকা। এই বাড়তি দামে ২৫ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ ৪৪ দিন চাল বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়তি নেওয়ায় দিনে ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত আদায় করা হয়েছে ৩৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এ হিসাবে ৪৪ দিনে নেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা। সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে গত ২৬ জুন বিভিন্ন চালের দাম কেজিতে ২ টাকা কমে যায়। ওইদিন মিনিকেটের দাম ৬৫ থেকে ২ টাকা কমে ৬৩ টাকা হয়। গত ৩০ জুন পর্যন্ত এই দরে বিক্রি হয়েছে। এই ৫ দিনে প্রতি কেজিতে বাড়তি নেওয়া হয়েছে ৩ টাকা। এ হিসাবে দিনে বাড়তি নেওয়া হয়েছে ২০ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে চার দিনে ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে ৪১ কোটি ১২ লাখ টাকা। দুই দফায় ৪৯ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। এ বিষয়ে নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, বাজারে চালের দাম বাড়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে ধানের দাম বৃদ্ধি। কৃষকরা ধান ঘরে মজুত করে রাখছে। হাটবাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। দাম বাড়লে বিক্রি করবেন এই আশায়। ফলে বাজারে ধানের সরবরাহ কমেছে। সে কারণে চাহিদার তুলনায় বাজারে ধানের সরবরাহ কম থাকায় ব্যবসায়ীরা বেশি দামে ধান কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এতে চালের দাম বেড়েছে। কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল বিক্রেতা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মিলারদের কারসাজি কেউ থামাতে পারছে না। তারাই চালের বাজার অস্থির করে রেখেছে। কিন্তু বাজারে চালের কোনো ধরনের ঘাটতি নেই। হাতেগোনা কয়েকটি বড় মিল মালিক কিছুদিন পরপর নানা অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে। সর্বশেষ ধানের দাম বাড়ার অজুহাতে মিল পর্যায় থেকে নতুন বাড়তি দর বেঁধে দেয়। সেই বাড়তি দরেই চাল কিনতে হয়। বিক্রিও করতে হচ্ছে বাড়তি দরে। এর প্রভাব খুচরা পর্যায়ে ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়ে। ফলে কাটা যায় ভোক্তার পকেট। জানতে চাইলে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নিয়মিত বাজার তদারকি করা হচ্ছে। মিল পর্যায়ে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। কোনো অনিয়ম সামনে এলেই আইনের আওতায় আনা হবে। এদিকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের গত ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে চালের চাহিদা মিটিয়ে আরও ৩০ লাখ টন উদ্বৃত্ত থাকবে। প্রতি মাসে চালের চাহিদা রয়েছে ২০ লাখ ২৮ হাজার টন। বছরে চাহিদা প্রায় ২ কোটি ৪৩ লাখ টন। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে দেশে ধান ও গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৯৫ কোটি ৫৩ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৩৭৬ কোটি ৩২ লাখ টন। সদ্যবিদায়ী অর্থবছরের মে পর্যন্ত খাদ্য আমদানি হয়েছে ৬১ লাখ ৮২ টন। এর আগের অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৬০ লাখ ৪০ হাজার টন। আলোচ্য সময়ে আমদানি বেড়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার টন। সদ্যবিদায়ী অর্থবছরেও ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় ধান সংগ্রহও সন্তোষজনক। ফলে ধান, চাল ও গমের সরবরাহ পরিস্থিতিও স্বাভাবিক। তারপরও কারসাজি করে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, মিলাররা যে অজুহাতই দেখাক না কেন, আসল বিষয় হচ্ছে সরকারের গুদামে চালের মজুত কম। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ত্রাণ সহায়তায় সরকারি গুদাম থেকে চাল বিতরণ করা হয়েছে। এতে সরকারের গুদামে চালের মজুত কমার কারণে মিলাররা সুযোগ নিয়ে দাম বাড়িয়েছে। সেদিকেও সরকারকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। মজুত বাড়ানো, দেশীয় উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ বাড়িয়ে দাম কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে কঠোরভাবে বাজার তদারকি করতে হবে। করোনার মধ্যে যাতে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো ঘাটতি তৈরি না হয় সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
Link copied!