শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পঙ্গু হাসপাতালের আউটডোর, টাকা ছাড়া সেবা মেলে না

প্রকাশিত: ১২:৪২ পিএম, আগস্ট ২২, ২০২২

পঙ্গু হাসপাতালের আউটডোর, টাকা ছাড়া সেবা মেলে না

৫ বছরের শিশু নুসরাত। মাস দেড়েক আগে খেলতে গিয়ে পা ভেঙে যায় তার। গত সোমবার তাকে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) নিয়ে আসেন তার বাবা। ভেঙে যাওয়া পায়ের প্ল্যাস্টার খুলে ড্রেসিং করিয়ে দ্বিতীয় দফা প্ল্যাস্টার করে দেন বহির্বিভাগে কর্মরত নার্সরা। নুসরাতের বাবার চেহারায় বিরক্তি ভাব। কারণ জানতে চাইলে বহির্বিভাগে কর্মরতদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ঝাঁপি খোলেন তিনি। নিয়মমতো ১০ টাকার টিকিট কাটলেও টাকা ছাড়া কেউ কথাই বলতে চান না। নুসরাতের পা ভাঙার পর হাসপাতালে নিয়ে আসলে বিনামূল্যের প্ল্যাস্টার করাতে ওই সময় নিয়েছিল ২ হাজার টাকা। এবার বহির্বিভাগে এসেছেন। পুরোনো প্ল্যাস্টার খুলে নতুন করে প্ল্যাস্টার করা হয়েছে। এবারো ১০ টাকার বাইরে তাদের চা-পান খেতে দিতে হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। মায়ের ভাঙা পা নিয়ে নোয়াখালী থেকে হাসপাতালে এসেছেন জয়নাল। আগের প্ল্যাস্টার ঠিকমতো না হওয়ায় ডাক্তার তার মাকে আবারো প্ল্যাস্টার করতে বলেছেন। নিয়মানুযায়ী টিকিট কাটলেও প্ল্যাস্টারসহ তাদের কাছে দাবি করেন ২ হাজার ২০০ টাকা। আগেরবার নিয়েছিল ১৮০০ টাকা। শুধু নুসরাতের বাবা বা জয়নালের অভিযোগ নয়, প্রতিদিন আউটডোরে আসা শত শত রোগীর একই অভিযোগ। উৎকোচ ছাড়া সেবা মেলা কল্পনাতীত এখানে। এই উৎকোচের পরিমাণ ৫০০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩ হাজার। বিভাগের ইনচার্জের তত্ত্বাবধানে এই টাকার ভাগ-বাটোয়ারা হয়। তবে সিনিয়র-জুনিয়র ভেদে এই ভাগ-বাটোয়ারায় কম-বেশি হয়ে থাকে। সরজমিন দেখা যায়, হাসপাতালের দেয়ালে পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল গণি মোল্লাহ স্বাক্ষরিত একটি নোটিশ সাঁটানো রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে- হাসপাতালে যেকোনো বিভাগে রোগীদের নিকট হতে ড্রেসিং, প্লাস্টার ও ট্রলিতে রোগীবহনসহ বিভিন্ন সেবার বিনিময়ে অর্থ গ্রহণের প্রমাণ মিললে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পঙ্গু হাসপাতালের নতুন ভবনের বহির্বিভাগের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় রয়েছে প্লাস্টার ড্রেসিং রুম। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এখানে সেবা দেয়া হয়। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা ছাড়া সেবা মেলে না রোগীদের। তাদের ভাষায় এটাকে বলা হয় বকশিস। তবে জোরজরবদস্তি করেই এই বকশিস আদায় করা হয় বলে সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ। এ বিভাগে কর্মরত রয়েছেন ৯ জন পুরুষ সিনিয়র স্টাফ নার্স। নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে এখানে দিনে সেবা নেন ৪০০-৫০০ রোগী। রোগীর স্বজনরা জানান, নার্সরা যার কাছ থেকে যেভাবে পারছেন বকশিসের নামে অবৈধভাবে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। গড়ে প্রতিদিন হাসপাতালটির এই বিভাগে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। বহির্বিভাগে কথা হয়, আবদুল্লাহপুর থেকে আসা ৭ বছর বয়সী শিশু লামিয়ার বাবা লোকমান হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, খেলতে গিয়ে দোতলার ছাদ থেকে পড়ে পা ভেঙে যায় লামিয়ার। আউডডোরে আনার পর প্ল্যাস্টার শেষে নার্স দাবি করে ২ হাজার টাকা। শেষমেশ দেন-দরবার করে ১২০০ টাকায় মিটিয়েছি। প্ল্যাস্টারের সরঞ্জাম ওরা নিজেরাই বাইরে থেকে কম দামে কিনে এনে আমাদের কাছে বেশি রাখে। অনেক সময় এক রোগী দিয়ে বেশি করে কিনিয়ে আরেক রোগীর কাজে লাগায়। ভাঙা পা নিয়ে নানীকে নিয়ে এসেছেন আরিফ। আরিফ এই প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেন তাদের দুর্ভোগের কথা। বলেন, আগের প্ল্যাস্টার করানোর ২০ দিন পর আবার ডাক্তার দেখালে তিনি বলেন অপারেশন করাতে। এখানে আসার পরে দেখি অনেক বড় সিরিয়াল। আগে ঢুকতে ডাক্তারের সহকারীকে ২শ’ টাকা দিয়েছি। আবার এখানেও প্ল্যাস্টার রুমে আগে ঢুকানোর জন্য ১শ’ টাকা দিয়েছি। আগের যে ব্যান্ডেজ ছিল সেটা খুলতে নার্স ১০০ টাকা নিয়েছে। অপারেশন করার জন্য যদি কোনো রুম লাগে, তা এখানকার পিয়ন রাকিব দেবে বলেছে। ৯ নম্বর রুমের মধ্যে থাকে। ও বলেছে, এক সপ্তাহ আগে জানাতে। তাহলে ও নিজেই ব্যবস্থা করে দেবে। আরিফের মামা জানান, প্ল্যাস্টার শেষে নার্স আবারো ২০০ টাকা নিয়েছে। এভাবে প্ল্যাস্টার কিনতে সুমন ৬০০ টাকা, পরে আরও ১০০০ টাকা, রেশমা বেগম ১২০০ টাকা, মিজান ৫০০ টাকা দিয়ে সেবা নিয়েছে। আবার বহিবির্ভাগের অনেক রোগীর কাছে স্টাফরা মোবাইল নম্বর দিয়ে রাখে। তারা বলে দেন, পরবর্তীতে আসার আগেই ফোন করতে। তাহলে সিরিয়াল লাগবে না। এমনকি বহির্বিভাগের টিকিটও কাটতে হবে না। দ্বিতীয়বার আসা অনেক রোগীই ঝামেলা এড়ানোর জন্য এই কৌশল অবলম্বন করেন। সূত্রে জানা যায়, এ বিভাগে কর্মরত প্রত্যেক নার্সকে বাধ্যতামূলকভাবে ১০০০ টাকা করে ইনচার্জ আলমগীর হোসেনকে দিতে হয়। কেউ এই টাকা দিতে অস্বীকার করলে নানাভাবে হেনস্তা করা হয়। এমনকি কাজও করতে দেয়া হয় না। বাড়তি আয়ের আশায় তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে ইনচার্জকে এই চাঁদা দিয়ে থাকেন। আলমগীরের চাঁদা পরিশোধ করার পর বাকি যা থাকে তা পকেটস্থ করেন নার্সরা। সম্প্রতি বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে বদলি করা ৭ জনের একজন আলমগীর। তাকে কক্সবাজার রামু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়। কিন্তু ওই আদেশের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আঁখি বেগম ছাড়া বাকি ৬ জন হাইকোর্টে রিট করেছে। বিষয়টি নিস্পত্তি না হওয়ায় এখনো হাসপাতালে রামরাজত্ব কায়েম করে চলেছেন। সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি নতুন করে হাসপাতালটিতে ২৪৬ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সকে পদায়ন করা হয়েছে। এদের মধ্যে খাইরুল ইসলাম, আল-সাহারিয়ার, মুশফিকুর রহমান, শফিকুর ইসলামকে বহির্বিভাগে পদায়ন করা হয়। কিন্তু আলমগীরের অনৈতিক প্রস্তাব মেনে না নেয়ায় তাদের কাজ করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। এসব অভিযোগের ব্যাপারে বহির্বিভাগের ইনচার্জ মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, প্ল্যাস্টার ও ড্রেসিংয়ের ক্ষেত্রে টাকা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। হাসপাতালে কোনো প্ল্যাস্টারের সরঞ্জাম নেই। প্ল্যাস্টার কিনে আনতে হয়। এনে দিলে নার্সরা কাজ করে দেয়। কেউ যদি তাড়াতাড়ি সুবিধা পাওয়ার জন্য নিজ ইচ্ছায় দেয় সেটা আলাদা হিসাব। এটা আমার পক্ষ থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আমাকে অনেক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় বলে এগুলো দেখার খুব কম সুযোগ হয়। এ ব্যাপারে হাসপাতালের নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট (মেট্রন) হোসনে আরা আক্তার বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। বিষয়টি আমি তদন্ত করে দেখবো। ৪ জনকে বহির্বিভাগে কাজ করার সুযোগ না দেয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ব্যাপারে আমাদের এখানে কোনো অভিযোগ আসেনি। আমি তাদের ডাকবো, জিজ্ঞেস করবো কেন তাদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না
Link copied!