চালু হলো প্রমত্তা পদ্মার বুকে স্বপ্নের সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাকাব্যিক এক ইনিংসে বাঙালি যেন পেল আরেক বিজয়। স্বাধীন বাংলাদেশের বিস্ময় জাগানো এ সাফল্যে উন্মোচিত হয়েছে সম্ভাবনার নানামুখী দুয়ার। বিশেষ করে পিছিয়ে থাকা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার ভাগ্যবদলে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে সেতুটি।
পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্বার খুলল। যার মধ্য দিয়ে এসব জেলায় প্রসার ঘটবে ব্যবসা-বাণিজ্যের। সৃষ্টি হবে নকুন নতুন শিল্পকারখানা, বাড়বে কর্মসংস্থান। ফলে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দক্ষিণাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ওপর। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জিডিপি বেড়ে দাঁড়াবে ২.৩ শতাংশ পর্যন্ত। আর এসব কারণেই সেতুটির উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ২১ জেলায় লাখো মানুষের সোনালি ভবিষ্যতের ঝলকানি শুরু হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
দিনবদলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করা এসব জেলা হচ্ছে- ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী। খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা এবং বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি।
সেতুর মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে এমন প্রশ্নের উত্তরে মাদারীপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান বলেন, এখন থেকে পরিবহন সেক্টরে আমূল পরিবর্তন ঘটবে। এর মধ্য দিয়ে কৃষিপ্রধান এসব এলাকা থেকে সারা দেশে সরাসরি পণ্য সরবরাহের সুযোগ মিলবে উদ্যোক্তাদের। ফলে উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবেও বলে জানান তিনি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেচে, দক্ষিণাঞ্চলে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে একাধিক নতুন উদ্যোক্তা। শরীয়তপুরের সদর উপজেলার চরডোমসারের বাসিন্দা মো. দেলোয়ার হোসেনও তেমন একজন। কৃষি খাতের এই উদ্যোক্তা নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন তালুকদার ডেইরি অ্যান্ড অ্যাগ্রো নামে বিশাল গরুর খামার। কৃষি খাতে আসার গল্প জানিয়ে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, পদ্মা সেতুই আমাকে এই সেক্টরে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী করেছে। চাকরি সূত্রে রাজধানীতে থাকা এই তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, আগামী দিনে এ খাত ঘিরেই স্বপ্ন বুনছেন তিনি।
সড়কপথে যোগাযোগ না থাকায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে সময় পার করতে হয়েছে যশোরের ফুল ব্যবসায়ীদের। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকার কারণে এতদিন এখানকার ব্যবসায়ীদের নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হতো। আশা করছি, এখন থেকে আমাদের উৎপাদিত ফুল আর নষ্ট হবে না। ব্যবসায়ও ফিরে আসবে সোনালি দিন।
এদিকে পর্যটন খাতের অন্যতম আকর্ষণ সাগরকন্যা কুয়াকাটায় সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ। সেতু চালু হওয়ায় পর্যটকদের ঢল নামবে বলে জানান পর্যটন ব্যবসায়ীরা। ফলে বিভিন্ন হোটেলে দক্ষ জনবল নিয়োগসহ নানা ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা।
সমুদ্র বাড়ি রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলাম বলেন, আমরা সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। পর্যটকের বাড়তি চাপের বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের হোটেলকে নতুন রূপে সাজিয়েছি। তৈরি করেছি নতুন নতুন প্যাকেজ।
এ ছাড়াও পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় মোংলা বন্দর ঘিরে বেড়েছে অপার সম্ভাবনা। বর্তমানে রাজধানীর সবচেয়ে কাছের বন্দর হিসেবে পরিণত হয়েছে মোংলা। ফলে সেতু-পরবর্তী সুফল কাজে লাগাতে বন্দরেও চলছে নানা কর্মযজ্ঞ। এ প্রসঙ্গে বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসা সময়ের আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর এই বন্দরের গতিশীলতা বেড়ে যাবে। সড়কপথে কম সময়ে এ বন্দর থেকে পণ্যবাহী কন্টেইনার ও কার্গো সারা দেশে পৌঁছানো সম্ভব হবে। তিনি আরও বলেন, এতদিন বন্দরটির সক্ষমতার মাত্র ৫০ শতাংশ ব্যবহৃত হতো। এখন থেকে বাকি ৫০ শতাংশ ব্যবহারের সব প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
ভাগ্যবদলের এই যাত্রা ঠিক কতদিনের মধ্যে দৃশ্যমান হবে এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আন্তঃজেলা বাণিজ্য ও যাতায়াতের ক্ষেত্রে কয়েক মাসের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যাবে। তবে শতভাগ সফলতার ক্ষেত্রে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি ওপর জোর দেন তিনি।