বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতু দিয়ে নতুন রুট: লক্কড়-ঝক্কড় বাসের পারমিট পেতে দৌড়ঝাঁপ

প্রকাশিত: ১২:০৯ পিএম, জুলাই ৩, ২০২২

পদ্মা সেতু দিয়ে নতুন রুট: লক্কড়-ঝক্কড় বাসের পারমিট পেতে দৌড়ঝাঁপ

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে যেমন সময় কম লাগছে তেমনি অর্থনৈতিকভাবে অধিক লাভবান হওয়ার পথও খুলে গেছে। তাই নতুন, পুরাতন বাসের সঙ্গে চলাচলে লক্কড়-ঝক্কড় ও অনুপযুক্ত গাড়ির মালিকরাও আবেদন করছেন রুট পারমিটের জন্য। এতে চলছে ঘুষ বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি। অভিযোগ রয়েছে, টাকার বিনিময়ে রুট পারমিটের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করছেন জেলা বাস মালিক সমিতির নেতারা। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের ১৫টি রুটে ১৫টি বেসরকারি বাস কোম্পানি ৬০০-৭০০ বাসের রুট পারমিটের জন্য আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির (আরটিসি) কাছে আবেদন করেছে। কারণ পদ্মা সেতু চালুর আগে ফেরি পারাপারে যে ভোগান্তি পোহাতে হতো তা এখন আর নেই। যে বাস আগের দিনে একটি বা দুইটি ট্রিপ দিত, সেটি এখন দূরত্বভেদে তিন থেকে চারটি ট্রিপ দিচ্ছে। অন্যদিকে যানজটতেও পড়তে হচ্ছে না। পদ্মা সেতুর কল্যাণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার জন্য বাসের যে নতুন রুট সৃষ্টি হয়েছে, তা যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে লাভজনক হয়ে উঠেছে। ফলে সড়কে বাস নামানোর জন্য এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। উপযুক্ত-অনুপযুক্ত সব ধরনের বাসের জন্যই রুট পারমিটের আবেদন করা হচ্ছে। এ সুযোগে পরিবহন নেতারা পাঁচ লাখেরও বেশি টাকা চাঁদা দাবি করছেন ওই রুটে গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়ার জন্য। বিষয়টি এখন টপ সিক্রেট। শুধু দক্ষিণাঞ্চলের বাস মালিকরা নন, দেশের উত্তরাঞ্চলে চলাচলকারী পুরাতন বাসের মালিকরাও নতুন এ রুটে বাস চালানোর অনুমতি চেয়েছেন। এক্ষেত্রে আরটিসির কিছু নেতা তাদের পছন্দের লোকদের বেছে বেছে রুট পারমিট দেওয়ার কৌশল নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশ না করা একজন নেতা। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু পার হয়ে চলাচল করা গাড়িগুলো ছাড়ে মূলত সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে। তবে কিছু বাস রাজধানীর রাজারবাগ, আরামবাগ, ফুলবাড়িয়া থেকেও ছাড়ে। আর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাসগুলো ছাড়ে মিরপুর-১২, আবদুল্লাহপুর ও গুলিস্তান থেকে। এসব বাস থেকে হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লক্কড়-ঝক্কড় বাস ঢাকা-ভাঙ্গা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলের জন্য উপযুক্ত নয়। সড়ক ফাঁকা থাকায় এসব গাড়ি বেপরোয়া চলাচলের আশঙ্কা থাকে। এতে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। তাই অনুপযুক্ত গাড়ি যাতে এ রুটে চলতে না পারে সে জন্য প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা কিছুদিন আগে বিআরটিএর বৈঠকে বলেছি, লক্কড়-ঝক্কড় বাস যেন পদ্মা সেতুতে না ওঠে। এ সেতু আমাদের গর্বের জায়গা। সেখানে যদি বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে হয় তাহলে সেটা বড় ধরনের দাগ কাটবে। এ ক্ষেত্রে যেন সরকার সতর্ক থাকে। এ রুটে চলাচলের জন্য বাসের ফিটনেস, রুট পারমিট দেওয়ার ক্ষেত্রে যেন সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া হয়। রুট পারমিটের জন্য চাঁদা নেওয়ার বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহর ফোনে কল করা হলে তিনি অসুস্থ আছেন জানিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, রেগুলেটরি অথরিটি হিসেবে আগে বিআরটিএকে উপযুক্ত হতে হবে। শুধু বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য অগ্রসর না হয়ে প্রতিষ্ঠান যদি তার ক্ষমতা যথাযথভাবে প্রয়োগ করে তাহলে কখনই এ রুটে লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি আসতে পারবে না। হাতিরঝিল, গুলশানে তো লক্কড়-ঝক্কড় আসতে পারেনি। এখানেও সে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু শুধু যাত্রীদের যাতায়াতের সেতু নয়, এটা অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। কিন্তু সেটা কাজে লাগানোর কোনো লক্ষণ দেখছি না। বরং একাধিক কোম্পানি বাস চালানোর জন্য এখন উঠেপড়ে লেগেছে। এটা হলে বিশৃঙ্খলা বাড়বে, দুর্ঘটনা ঘটবে। সুফল পাচ্ছে পটুয়াখালী ও পায়রা সমুদ্রবন্দর পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ঢাকা-পটুয়াখালী রুটে বেড়েছে যাত্রীর সংখ্যা। ফলে জেলার যাত্রী ও কুয়াকাটায় পর্যটকদের চাহিদা মেটাতে নামানো হচ্ছে নতুন বাস। এ বিষয়ে পটুয়াখালী বাস মালিক গ্রুপের সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম বাদশা জানান, নতুন অনেক পরিবহন ঢাকা-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা রুটে বাস সার্ভিস চালু করেছে। এখন নতুন নতুন অনেক গাড়ি এ রুটে ঢুকছে তার মধ্য গ্রিন লাইন, সোহাগ, গ্রিন সেন্টমার্টিন, ডলফিন, সিবিসি পরিবহন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া এ রুটে সাকুরা, হানিফ, মোল্লা, প্রচেষ্টাসহ বিভিন্ন পরিবহন নিয়মিত সার্ভিস দিচ্ছে। পাশাপাশি বন্দরে আমদানিকরা পণ্য স্বল্প সময় ও সহজ পদ্ধতিতে খালাস করে গন্তব্যে পাঠাতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে পদ্মা সেতু। পায়রা বন্দর থেকে ঢাকার দূরত্ব ২৭০ কিলোমিটার। নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ মাধ্যম উন্মোচিত হওয়ায় দূরত্ব অতিক্রমে সময় কম লাগছে। এখন মাত্র সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টায় পণ্যবাহী গাড়ি বন্দর থেকে ঢাকা যেতে পারছে। ফলে আমদানিকারকরা এ পথে পণ্য আনা-নেওয়ায় উদ্বুদ্ধ হবেন। শরীয়তপুরে বাস মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা চরমে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরেও যাতায়াতের ক্ষেত্রে চরম দুর্ভোগ পড়েছেন শরীয়তপুরবাসী। ‘শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস’ নামে একটি বাস কোম্পানি অন্য কোনো কোম্পানির বাস চলাচল করতে দিচ্ছে না। শুধু তাই নয়, বিআরটিসির বাসও আটকে দিচ্ছে তারা। দুই দফা ভাঙচুর করে যাত্রীদের বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এ কোম্পানির বাস নিয়ন্ত্রণ করে জেলা বাস মালিক গ্রুপ। তারা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়াও আদায় করে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সঙ্কট নিরসনে গত ২৭ জুন বাস মালিক সমিতির নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় পরীক্ষামূলকভাবে আগামী এক মাস বিআরটিসির আটটি বাস ঢাকা-শরীয়তপুরের বিভিন্ন উপজেলা শহর থেকে চলবে। কিন্তু শরীয়তপুর শহর থেকে কোনো যাত্রী উঠাতে পারবে না। এমন সিদ্ধান্তের পরেও বৈঠকের পরের দিন ঢাকা থেকে আসা গোসাইরহাটগামী একটি বিআরটিসি বাস শরীয়তপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা দিয়ে যেতে বাধা দেওয়া হয়। শরীয়তপুর জেলা বাস মালিক গ্রুপের লোকজন বাসে থাকা সব যাত্রীকে জোর করে নামিয়ে দেয় বলে জানান শরীয়তপুর বিআরটিসি বাসের ডিপো ইনচার্জ বুলবুল আহামেদ।
Link copied!