শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ মাসে চার বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা

প্রকাশিত: ০৩:১২ পিএম, জানুয়ারি ২০, ২০২২

পাঁচ মাসে চার বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা

করোনা মহামারির কারণে প্রায় দেড় বছর বন্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। ১২ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খুলতে লেগে যায় আরও প্রায় এক মাস। দীর্ঘ বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সৃষ্টি হয়েছে সেশনজট। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে যখন তোড়জোড় চলছে, তখন বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছোট-বড় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে চলেছে। এমনকি কোথাও সচল হওয়ার আগে থেকেই শুরু হয় এই পরিস্থিতি। এসব কারণে এখন পর্যন্ত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়, একটি মেডিকেল কলেজ ও একটি কলেজের ছাত্রাবাস বন্ধ করতে হয়েছে। দেখা গেছে অনেক ছোট ঘটনা অসহিষ্ণুতায় বড় আকার ধারণ করে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) এগুলোর একটি। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল। উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে বুধবার আমরণ অনশনে গেছেন তারা। দেশে বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে অর্ধশত, আর বেসরকারি শতাধিক। সাধারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজের অস্থিরতা আলোচনায় আসে। গত ৫ মাসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যকার মারামারি আর সংঘর্ষের ঘটনায় এই সময়ে সবচেয়ে বেশি খবরের শিরোনাম হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। বিভিন্ন হলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অন্তত ১২ বার সংঘর্ষ হয়েছে। তবে বেশি আলোচনায় এসেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ও রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় (রবি)। এগুলোর মধ্যে চমেকে ছাত্রলীগের এক গ্রুপের হাতে আরেক গ্রুপের এক কর্মী নির্মম পিটুনির শিকার হন। তার মাথার খুলি কেটে পেটের চামড়ার নিচে রেখে চিকিৎসা করতে হয়েছিল। কুয়েটে একটি হলের প্রভোস্টকে মানসিক নির্যাতনের পর তার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমেছিলেন। শেষে অভিযুক্তদের বহিষ্কার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। রবিতে ছাত্রদের চুল কেটে দেওয়ার ঘটনায় ফুঁসে ওঠেন ছাত্ররা। ওই ঘটনায় পরিস্থিতি বাগে আনতে কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্ত শিক্ষককে বরখাস্ত করে। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় শেষে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। আর এখন অস্থিরতা বিরাজ করছে শাবিতে। শুধু তাই নয়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৬ জানুয়ারি অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থী হল-ক্যাম্পাস ছাড়েনি। এই ঘটনার রেশ ইতোমধ্যে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকাসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ মিছিল করেছে। অন্যদিকে কয়েকদিন ধরে চবিতেও ছাত্রদের মধ্যে মারামারি লেগেই আছে। শাবি এবং রবির ঘটনা বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই ঘটনারই নেপথ্যে আছেন অল্পবয়সি অনভিজ্ঞ শিক্ষকরা। শাবিতে যে হল প্রভোস্টের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আচরণগত সমস্যা তৈরি হয়েছে, তিনি সহযোগী অধ্যাপক। আর রবিতে ছাত্রদের চুল কেটে দেওয়া শিক্ষকও সহকারী অধ্যাপক। অন্যদিকে শাবির বর্তমান প্রক্টর একজন সহযোগী অধ্যাপক। সাধারণত ক্যাম্পাসের ঘটনা দ্রুত হস্তক্ষেপ করেন প্রক্টর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপেক্ষাকৃত সিনিয়র বা অধ্যাপকরা দায়িত্বে থাকলে ছাত্রদের সঙ্গে বোঝাপড়া সহজ হয়। ফলে কোনো ঘটনা সহজে বড় আকার ধারণ করে না। দেশের সাবেক দুই প্রখ্যাত উপাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেন, শিক্ষার্থীদের বয়স কম। তারা আবেগ দিয়েই বেশির ভাগ কাজ করে থাকে। এ অবস্থায় ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে হয়। এক্ষেত্রে তাদের সহনশীল, সংবেদনশীল ও সহমর্মী হতে হয়। কিন্তু বর্তমানে কোথাও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না। যে কারণে ছোট ঘটনাও বড় আকার ধারণ করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, রবি এবং শাবির ঘটনা দুটির উৎস প্রায় একই ধরনের। সেটি হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুই জুনিয়র শিক্ষকের আচরণগত সমস্যা। এটা ভাবনার বাইরে যে, একজন শিক্ষক কী করে ছাত্রদের চুল কেটে দিতে পারেন। আবার ছাত্রীরা রাতে কথা বললেই কেন সেটা নিতে পারবেন না একজন প্রভোস্ট? তিনি নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বলেন, ১৭ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থেকেও পুলিশ ব্যবহার করিনি। সন্তানের মতো ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে পুলিশের হস্তক্ষেপ লাগবে কেন? আসলে ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা থাকতেই পারে। ক্যাম্পাসে শিক্ষকরা অভিভাবক। তারা সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। তবে তিনি এটাও মনে করেন, যেহেতু উপাচার্য পুলিশকে অ্যাকশনে যেতে বলেননি, তাহলে কে সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহারের আদেশ দিলেন আর কে বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করেছে। ক্যাম্পাসে এটা প্রথম প্রয়োগ। এর পেছনে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা- তা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইউজিসি সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী বলেন, যে কোনো ঘটনা ছোট থেকেই বড় আকার ধারণ করে। উপাচার্যের পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়। এখন দ্রুত যেটা করা দরকার সেটা হচ্ছে, ছাত্রছাত্রীদের কাছে সিন্ডিকেট থেকে দুঃখ প্রকাশ করা। কেননা শিক্ষার্থীরা আবেগী। তাদের আবেগ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ভালো কাজে ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি তিনি শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, করোনায় এমনিতে শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত। দুই বছরের সেশনজট তৈরি হয়েছে। এখন আন্দোলন করে যদি এই পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত করা হয় তাহলে তাদেরই ক্ষতি। তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণের পরামর্শ দেন। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রীও বৈঠক করেন। সেখানেও তিনি ক্যাম্পাসে কথায় কথায় পুলিশ না ডাকতে পরামর্শ দেন। পাশাপাশি উদ্ভূত সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান, ক্যাম্পাসে নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত এবং করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। শাবিতে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিতেও তিনি পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, সরকার চায় ক্যাম্পাস শান্তিপূর্ণ থাকুক। করোনা এবং অস্থিরতা-এই দুই সমস্যা না ঘটুক। কেননা একবার ঘটে গেলে তা সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। আর এমনটি হলে সেশনজট বাড়ার মাধ্যমে ছাত্ররাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, শাবির ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। তবে এখন সিনিয়র শিক্ষকরা এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে পারেন। উপাচার্যের পদত্যাগে সমস্যার সমাধান নেই। তিনিও মনে করেন, পুলিশ ব্যবহার করে সমস্যা সমাধানে না গিয়ে ছাত্রদের ডেকে বসে সমাধান করা যেতে পারে। পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতি কখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
Link copied!