বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পানির দাম ও এমডির বেতন

প্রকাশিত: ১১:২৮ এএম, জুন ১৮, ২০২১

পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পানির দাম ও এমডির বেতন

ঢাকা ওয়াসার পানিসংকট নিয়ে নগরবাসীর অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সংস্থার অন্যান্য সেবা নিয়েও আছে বিস্তর অভিযোগ। কিন্তু তারপরও গত ১৩ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ানো হয়েছে সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের বেতনও। সর্বশেষ করোনা মহামারির মধ্যে এক লাফে ওয়াসার এমডির বেতন বাড়ানো হয়েছে পৌনে ২ লাখ টাকা। এই বৃদ্ধির পর ওয়াসার এমডি হিসেবে তাঁর মাসিক বেতন দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। এ হিসাবে গত ১২ বছরে তাকসিম এ খানের মাসিক বেতন বেড়েছে ৪২১ শতাংশ। এদিকে তাকসিমের পরে যাঁরা ওয়াসার এমডি হবেন, তাঁরা যেন এই পরিমাণ বেতন না পান, সেটিও নিশ্চিত করেছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। ওয়াসার মতো প্রতিষ্ঠানের এমডির বেতন-ভাতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন কমিশন করা প্রয়োজন। যাঁরা সংস্থাটির আয়-ব্যয় ও আনুষঙ্গিক বিষয় বিবেচনা করে এবং জনমত নিয়ে বেতন-ভাতার প্রস্তাব করবেন। ২০০৯ সালের অক্টোবরে তাকসিম এ খান ওয়াসার এমডি হিসেবে ৩ বছরের জন্য চুক্তিতে নিয়োগ পান। ওয়াসা সূত্র জানায়, তখন তাঁর সর্বমোট মাসিক বেতন ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এর মধ্যে মূল বেতন ছিল ৬০ হাজার টাকা। অন্যান্য খাতের মধ্যে বাড়িভাড়া ২০ হাজার, উৎসব ভাতা ১০ হাজার, মেডিকেল ও বিনোদন ভাতা ৪ হাজার এবং বিশেষ ভাতা ২২ হাজার টাকা। তার সঙ্গে চুক্তিতে বলা ছিল, বেতনবাবদ প্রদেয় আয়কর তাকসিমকেই দিতে হবে। এরপর ২০১০ সালে ওয়াসার এমডির বেতন ২ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ওয়াসার নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ২৪ জানুয়ারি ওয়াসা বোর্ডের ২৩১তম সভায় এমডির বেতন সাড়ে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সে সময় এক লাফে এমডির বেতন বাড়ানো হয়েছিল আড়াই লাখ টাকা, যা কার্যকর হয় ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে। ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের ২৭২তম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বরে। ওই সভায় এমডির পারিশ্রমিকসহ সুযোগ-সুবিধা, বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সম্মানী পুনর্নির্ধারণের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়। গঠিত কমিটি দুই দফায় বৈঠক করে এমডির বেতন-ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করে। ২০০৯ সালের অক্টোবরে তাকসিম এ খান ওয়াসার এমডি হিসেবে ৩ বছরের জন্য চুক্তিতে নিয়োগ পান। তখন তাঁর সর্বমোট মাসিক বেতন ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। গত ১২ বছরে তাঁর মাসিক বেতন বেড়েছে ৪২১ শতাংশ। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের ২৭৬তম সভায় কমিটির প্রস্তাবের ভিত্তিতে এমডির বেতন-ভাতার বিষয়ে আলোচনা হয়। সভায় উপস্থাপিত নথি অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৪ অক্টোবর এমডির বেতন-ভাতা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। সেবাদানকারী অন্যান্য কোম্পানির (ডিপিডিসি, ডেসকো, পাওয়ার গ্রিড) অভিন্ন বেতন স্কেল ২০১৬ অনুযায়ী, ২০২১ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বেতন-ভাতা দাঁড়ায় ৫ লাখ ৩ হাজার ৫৬২ টাকা। প্রথম সারির সরকারি কোম্পানি জনতা, সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের এমডিদের বেতন ৪ লাখ টাকা। কমিটি ঢাকা ওয়াসার এমডির মাসিক বেতন ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা প্রস্তাব করে। কমিটির এমন প্রস্তাবের পেছনে কারণ হিসেবে বলা হয়, বর্তমান এমডির যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, ঢাকা ওয়াসার বিগত বছরের ব্যাপক উন্নয়নে তাঁর অবদান, মুদ্রাস্ফীতি এবং দেশের অন্যান্য সমমানের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এমডিদের বেতন-ভাতা পর্যালোচনা। সভা সূত্র জানায়, সভায় ওয়াসার বোর্ড সদস্য প্রকৌশলী এ কে এম এ হামিদ বেতন বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘ব্যবস্থাপনা পরিচালক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। চুক্তির সময় তাঁর বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা আছে। এমডি এখন চার লাখ টাকার বেশি বেতন পাচ্ছেন। বিভিন্ন ব্যাংকে এমডির বেতন চার লাখ টাকার ওপরে নেই। ব্যাংকের এমডির দায়িত্ব সারা বাংলাদেশে আর ঢাকা ওয়াসার এমডির দায়িত্ব ঢাকা শহরে। সে হিসেবে এই বেতন বেশি হচ্ছে কি না? এত বেশি বেতন কোনো প্রতিষ্ঠানে আছে বলে আমার জানা নেই।’ এমডিকে অতিরিক্ত ৩ বছরের জন্য নিয়োগের সময় বেতন-ভাতার বিষয়ে কিছু বলা ছিল না। ৫ বছরে একজন মানুষের বেতন একই থাকতে পারে না। মূল্যস্ফীতির বিষয়টি মাথায় রেখে বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে। প্রশ্ন উঠলেও সভায় এমডির বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের বেতন সর্বসাকল্যে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। সভার আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাকসিমের অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করে এই বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে অন্য কারও জন্য প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ ভবিষ্যতে যাঁরা এমডির দায়িত্বে আসবেন, তাঁদের জন্য এই বেতন-ভাতা প্রযোজ্য হবে না। গত ২ মার্চ ওয়াসার সচিব শারমিন হক আমীর এমডির বেতন-ভাতার বিষয়ে ওয়াসার পরিচালককে (অর্থ) একটি চিঠি দেন। তাতে বলা হয়, তাকসিমের বেতন এখন থেকে সর্বসাকল্যে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ঢাকা ওয়াসার হিসাব বিভাগের মে মাসের নথিতে দেখা যায়, তাকসিম এ খান গত মে মাসে মূল বেতন পেয়েছেন ২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। উৎসব ভাতা ৪৭ হাজার ৬৬৭ টাকা, বাড়িভাড়া ৩৫ হাজার, চিকিৎসা এবং আপ্যায়ন ভাতা ৩৫ হাজার ৭৫০ টাকা করে, বিশেষ ভাতা ১ লাখ ৮০ হাজার ৬৬ টাকা ও বাংলা নববর্ষ ভাতা ৪,৭৬৭ টাকা। তাকসিম এ খান গত এপ্রিল মাসে তিন মাসের ছুটিতে যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে থেকে তিনি ওয়াসার নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন বিষয়ে ফোন ও অনলাইনে তদারকি করছেন। বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে প্রশ্ন পাঠানো হয়, তিনি সেটি দেখলেও কোনো উত্তর দেননি। ওয়াসার উপপ্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেককে প্রশ্ন পাঠানো হলে তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে উত্তর পাঠান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘এমডির বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ কম হয়েছে নাকি বেশি হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করতে চাই না।’ পরে তিনি বলেন, এমডিকে অতিরিক্ত ৩ বছরের জন্য নিয়োগের সময় বেতন-ভাতার বিষয়ে কিছু বলা ছিল না। ৫ বছরে একজন মানুষের বেতন একই থাকতে পারে না। মূল্যস্ফীতির বিষয়টি মাথায় রেখে বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে। ওয়াসার এমডির বেতন-ভাতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ওয়াসার পানির দাম। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে ঢাকা ওয়াসার আবাসিক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) পানির দাম ছিল ৬ টাকা ৪ পয়সা। সর্বশেষ গত ২৪ মে পানির দাম আবারও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা কার্যকর হবে আগামী ১ জুলাই থেকে। নতুন দর অনুযায়ী আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম দাঁড়াবে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। করোনা মহামারির শুরুর দিকে গত বছরের এপ্রিলেও পানির দাম বাড়িয়ে ছিল ঢাকা ওয়াসা। ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থ হওয়ায় এই দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) ইতিমধ্যে ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন মহাপরিকল্পনা থাকলেও সেটির বাস্তবায়ন একেবারেই কম। এতে ঢাকার বড় অংশ এখনো পয়োনিষ্কাশন সুবিধার বাইরে। সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ওয়াসার ‘উন্নয়নে’ অবদান রাখায় এমডির বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, যে বোর্ড সদস্যরা এমডির বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করেছেন, তাঁরা তো নির্বাচিত না। ফলে বোর্ড সদস্যদের কোনো জবাবদিহিও নেই। ওয়াসার মতো প্রতিষ্ঠানের এমডির বেতন-ভাতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন কমিশন করা প্রয়োজন। যাঁরা সংস্থাটির আয়-ব্যয় ও আনুষঙ্গিক বিষয় বিবেচনা করে এবং জনমত নিয়ে বেতন-ভাতার প্রস্তাব করবেন। সূত্র: প্রথম আলো
Link copied!