শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশ শুধু খবর পায়, ধরা পড়ে না জিয়া

প্রকাশিত: ১১:৪৬ এএম, নভেম্বর ৫, ২০২২

পুলিশ শুধু খবর পায়, ধরা পড়ে না জিয়া

মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি হয়েও মাঝেমধ্যে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যান। পুকুরে গোসল করেন, মাছও ধরেন। ঢাকায় আসেন টাকা তুলতে। সেই টাকা আবার শ্বশুরবাড়িতে পাঠান—এসব তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলোর হাতে এলেও ধরা পড়েন না নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে জঙ্গি জিয়া। অভিজিৎ রায়, ফয়সাল আরেফিন দীপন ও জুলহাস-তনয় খুনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জিয়ার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিলে ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার দেবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। বাংলাদেশ সরকার দেবে ২০ লাখ টাকা। ঢাকা মহানগর পুলিশের জঙ্গি-উগ্রবাদ দমনে গঠিত কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, গোয়েন্দা তথ্য বলছে জঙ্গি জিয়া দেশেই আছে। কয়েক দফা তাকে গ্রেপ্তারের খুব কাছাকাছি গেলেও শেষ পর্যন্ত ধরা যায়নি। এ ধরনের জঙ্গিরা ‘কাটআউট’ পদ্ধতিতে চলাফেরা করে বলেই ধরা কঠিন জানান তিনি। এ কর্মকর্তা আরও বলেন, সর্বশেষ গুলিস্তান থেকে দুই দফা নিজের সংগঠনের এক সদস্যের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন জিয়া। আরেক দফা নেওয়ার কথা ছিল। সে অনুযায়ী জালও ফেলেছিল পুলিশ। তবে তাতে পা দেননি জিয়া। বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা জানালেন, দুর্ধর্ষ এ জঙ্গিকে গ্রেপ্তারে এক সময় নির্ঘুম রাতও কেটেছে তাদের। টানা অভিযানে আনসার আল ইসলামের নৃশংসতা কমে এলে মাঝে জিয়াকে গ্রেপ্তারে কিছুটা ভাটা পড়ে। তবে চেষ্টা থেমে যায়নি। সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, যত জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সবার কাছ থেকেই জিয়ার তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। গোয়েন্দা কার্যক্রম ও প্রযুক্তিগত তদন্ত সমন্বয় করে জিয়ার অবস্থান অনুমান করে কয়েকবার অভিযান চালানো হয়েছিল। ফাঁসির দণ্ড মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়ানো জিয়া সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর। ২০১১ সালে সরকার উৎখাতে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের বিষয়টি জানাজানি হলে পালান তিনি। ২০১৩ সালের আগস্টে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসে সৈয়দ জিয়াউল হকের জঙ্গি সম্পৃক্ততা। ওই সংগঠনের আরেক নেতা জসীমুদ্দীন রাহমানীকে গ্রেপ্তারের পর জিয়ার সম্পৃক্ততার বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হয় পুলিশ। ওই সংগঠনটিই পরে ‘আনসার আল ইসলাম’ নামে নৃশংসতা চালায়। পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, জিয়া গত বছর ঢাকার গুলিস্তানের আহাদ পুলিশ বক্সের পেছনে তার সংগঠনের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা নিয়েছেন। সেই ব্যক্তি জানতেন না, ওই লোকই পলাতক জিয়া। টাকা দেওয়া ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ছবি দেখালে তিনি জানান টাকা নেওয়া লোকটাই ছিল জিয়া। জিয়ার আস্তানা : জিয়াকে অনুসরণে যুক্ত পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও ময়মনসিংহে ছিলেন জিয়া। ২০১৯ সালে ঈদুল ফিতরের আগে চট্টগ্রামে রেলের টিকিটও কাটেন। ঢাকার মোহাম্মদপুর ও বাড্ডায় থেকেছেন দীর্ঘদিন। টঙ্গীতে এক বিয়ের অনুষ্ঠানেও হাজির হয়েছিলেন। ময়মনসিংহে আরেক জঙ্গির বাড়িতে ছিলেন কয়েক মাস। সন্তানদের খোঁজ নেন না : সিটিটিসি সূত্র জানায়, পলাতক অবস্থাতেই নোয়াখালীর একটি এলাকায় তৃতীয় বিয়ে করেন জিয়া। বিয়ের সময় তার শ্বশুর ছিলেন কারাগারে। ওই বিয়ের ব্যবস্থা করে আনসার আল ইসলামের এক সদস্য। তখন কারাফটক থেকে নেওয়া হয় শ্বশুরের অনুমতি। তিনিও জানতেন না, জঙ্গি জিয়ার কাছেই বিয়ে হচ্ছে মেয়ের। চার-পাঁচবার জিয়া ওই শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, সর্বশেষ তিন বছরে জিয়া তার শ্বশুরবাড়ি গেছেন বলে তাদের কাছে তথ্য নেই। তবে খবর পেয়ে তারা ওই সময় নোয়াখালী গিয়েছিলেন। ওই সংসারে জিয়ার দুটি মেয়ে রয়েছে। তবে তার স্ত্রী-কন্যারা এখন আর নোয়াখালীতে যান না। জিয়ার এক সময়ের বন্ধুরা পুলিশকে বলেছেন, চাকরিরত অবস্থাতেই ২০০৯ সালে জিয়ার প্রথম স্ত্রী মারা যান। দেড় মাসের মধ্যে দ্বিতীয় বিয়ে করেন জিয়া। ওই সংসারেও দুটি সন্তান রয়েছে। তার প্রথম শ্বশুর ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। তার কাছে জিয়ার প্রথম সংসারের একমাত্র ছেলে সন্তান থাকে। তবে জিয়া তার খোঁজখবর নেন না। জিয়া এখন কোথায় : পুলিশের জঙ্গিবিরোধী ইউনিটের নানা স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আভাস পাওয়া গেছে, দুর্গম চরাঞ্চল রয়েছে, এমন কোনো জেলায় পরিচয় গোপন করে বাস করছেন জিয়া। গোয়েন্দাদের ধারণা, এখন তার দাড়ি নেই। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই কারও কাছে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার আহমেদুল ইসলাম বলেন, নিষিদ্ধ আনসার আল ইসলামের নামে বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে বড় অঙ্কের টাকা আসার তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। তাদের ধারণা, এ টাকার একটা অংশ জিয়ার কাছে যায়। সম্প্রতি ‍হুন্ডির টাকা গ্রহণকারী সাইফুল ইসলাম ওরফে শাকিল নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংগঠনটির ‘ভল্ট’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন শাকিল। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, সংগঠনের দায়িত্বশীলের হাতের টাকা পৌঁছানোর দায়িত্ব ছিল তার। সিটিটিসি সূত্র বলছে, শাকিলের দেওয়া সেই দায়িত্বশীলের বিবরণ শুনে মনে হয়েছে, জিয়াও তার কাছ থেকে টাকা নিতেন। ২০২১ সালের কোরবানির ঈদের আগেও তার কাছ থেকে জিয়া টাকা নিয়েছে বলে জানান গোয়েন্দারা। কেন ধরা যাচ্ছে না : পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, জিয়া ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময়ই মেধাবী ছিল। বাহিনীতে চাকরিরত অবস্থাতেও ছিল চৌকস কর্মকর্তা। নিজেকে রক্ষার সব কৌশলই তার জানা। প্রযুক্তি বিষয়েও ধারণা আছে। তাই তাকে আটকানো যাচ্ছে না। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, এখন যারা আনসার আল ইসলামের জঙ্গি, তারা জিয়াকে চেনে না। গ্রেপ্তারের পর ছবি দেখালে বলে যে জিয়াকে দেখেছিল। ওই কর্মকর্তা বলেন, ২০১৬ সালের পর টানা অভিযানে জঙ্গি জিয়ার অনেক সহযোগী নিহত হয়েছে। অনেকে আছে কারাগারে। তারা জিয়ার চলাফেরা সম্পর্কে ধারণা রাখলেও এখনকার অনুসারীরা তাকে দেখেনি। জিয়ার গ্রেপ্তার না হওয়া এবং এর নিরাপত্তা ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে চাইলে নিরাপত্তা ও জঙ্গি কার্যক্রম বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, জিয়া প্রশিক্ষিত জঙ্গি। এজন্য নিজের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা করে রাখতে পারে। বিভিন্ন জায়গায় তার সমর্থক গোষ্ঠী আছে। এজন্য নিরাপদে গা-ঢাকা দিতে পারে। আর এমনিতেও এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না এরা। তিনি আরও বলেন, এমন দুর্ধর্ষ জঙ্গির গ্রেপ্তার না হওয়াটা নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকির বিষয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ওসামা বিন লাদেনও কিন্তু শেষ পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে পারেনি। জঙ্গি ও অপরাধ কার্যক্রম বিশ্লেষক মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, জিয়া দেশে থাকলেও তার অপতৎপরতা চালানোর সুযোগ নেই বলে মনে হচ্ছে। কারণ আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গি দমনে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে।
Link copied!