শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিমন্ত্রীর বয়স হয়েছে তাই আত্মীয়স্বজন নিয়ে যাচ্ছেন

প্রকাশিত: ১০:৪০ এএম, মে ১১, ২০২২

প্রতিমন্ত্রীর বয়স হয়েছে তাই আত্মীয়স্বজন নিয়ে যাচ্ছেন

ডেইলি খবর ডেস্ক: প্রতিমন্ত্রীর বয়স হয়েছে তাই আত্মীয়স্বজন নিয়ে জেনেভায় শ্রম সম্মেলনে যাচ্ছেন।আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে অংশ নিতে বাংলাদেশের ৪৩ জন প্রতিনিধির একটি বহর ১৬ দিনের সফরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যাচ্ছে। সম্মেলনটি আয়োজন করছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। ২৭ মে এটি শুরু হয়ে চলবে আগামী ১৩ জুন পর্যন্ত। সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। সফরে তাঁর মেয়ে, জামাতা ও চাচাতো ভাই সঙ্গী হচ্ছেন। শুধু প্রতিমন্ত্রী নন, মন্ত্রণালয়ের তিনজন কর্মকর্তা তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে জেনেভায় যাচ্ছেন। বহরে আরও থাকছেন দুজন সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা, কয়েকজন শ্রমকনেতা ও কয়েকটি সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা।শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এবার যে ৪৩ জন প্রতিনিধি জেনেভা সফরে যাচ্ছেন, তার মধ্যে ২৫ জনের ব্যয় বহন করবে সরকার। বাকিরা নিজেদের খরচে যাবেন। প্রতিমন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের স্বজনেরা তাঁদের ব্যয় নিজেরা বহন করবেন।এই সফরে শ্রম মন্ত্রণালয় ১১ জনের পেছনে ব্যয় করবে দেড় কোটি টাকা। একেকজনের পেছনে সরকারের গড় ব্যয় প্রায় ১৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। অন্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের ব্যয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে নেওয়া হবে। সব মিলিয়ে এই সফরে সরকারি কোষাগার থেকে মোট কত টাকা খরচ হবে, তা জানা যায়নি।এখন বিদেশে যাওয়ার মানে হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের সুবিধা দেওয়া। এটা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়। ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি।এই সফরটি নিয়ে দুটি প্রশ্ন উঠেছে। এক, এত বিপুলসংখ্যক মানুষ শ্রম সম্মেলনে অংশ নিতে যাওয়ার প্রয়োজন আছে কি না। দুই, নিজেদের খরচে গেলেও মেয়ে, জামাতা, ভাই, স্ত্রী, সন্তানদের সরকারি সফরে নেওয়ার যৌক্তিকতা কী। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি সফরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গেলে সরকারি কাজের ক্ষতি হয়। করোনা মহামারির আগে দুবার আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, এ ধরনের সম্মেলনে অন্য দেশ থেকে ৫ থেকে ১০ জনের মতো প্রতিনিধি অংশ নিতে দেখা যায়। খুব বেশি লোক যাওয়ার মতো কাজ সেখানে থাকে না।উল্লেখ্য, শুধু এবার নয়, আগেও আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে অংশ নিতে বাংলাদেশ থেকে বড় বহর গেছে। ২০১৯ সালে জেনেভায় একই সম্মেলনে অংশ নিতে গিয়েছিলেন ৪৯ জন। যাচ্ছেন যাঁরা-শ্রম মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,এবারের সম্মেলনে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ, কর্মসংস্থান, শিক্ষানবিশ কর্মীদের কাজের যোগদান নিয়ে একটি নির্দেশিকা তৈরি, কর্মপরিবেশ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।৪৩ জনের বহরে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পাঁচজন,শ্রম অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের চারজন করে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) একজন করে, এ¤øয়ার্স ফেডারেশনের চারজন,জাতীয় শ্রমিক লীগের তিনজন, জাতীয় মহিলা শ্রমিক লীগের দুজন রয়েছেন।বাকিদের মধ্যে রয়েছেন দুজন সংসদ সদস্য,প্রতিমন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের স্বজন, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, সিবিএ নেতা ও অন্য ব্যক্তিরা।জারি হওয়া সরকারি আদেশ (জিও) পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর মেয়ে সুফিয়া সুলতানা পারভীন, জামাতা গাজী মনিবুর রহমান ও চাচাতো ভাই কাজী বাপ্পীর সফরসঙ্গী হিসেবে যাওয়ার কথা রয়েছে।প্রতিমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তাঁর ভাই শাহাবুদ্দীন আহমেদ। তিনিও সফরসঙ্গী হচ্ছেন। প্রতিমন্ত্রীর স্বজনেরা ব্যক্তিগত খরচে জেনেভায় যাবেন।২০১৯ সালে আইএলওর সম্মেলনেও প্রতিমন্ত্রী তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে জামাতা গাজী মনিবুর রহমানকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওই বছর প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আরও গিয়েছিলেন তাঁর নাতনি মারিয়া রহমান ও আত্মীয় মো. সাজ্জাদুর রহমান।স্বজনদের নিয়ে সরকারি সফরে যাওয়ার বিষয়ে মন্নুজান সুফিয়ান বলেন,‘আমার বয়স হয়েছে। তাই সহযোগিতার জন্য মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি।’ জামাতা ও চাচাতো ভাই কেন যাচ্ছেন, জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তাঁরা দেখতে যাবেন, ঘুরতে যাবেন। সহজে তো ভিসা পাওয়া যায় না। তাঁরা থাকবেন না, চলে আসবেন।’সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন,প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্যে স্পষ্ট যে সরকারি সফরকে তাঁর স্বজনেরা ভিসা পাওয়ার উপায় হিসেবে ব্যবহার করছেন।প্রতিমন্ত্রীর পাশাপাশি সরকারের তিনজন কর্মকর্তা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুইজারল্যান্ড যাবেন বলে কথা রয়েছে। তাঁদের একজন শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী (অতিরিক্ত সচিব)। তিনি যাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী নিঘাত সুলতানাকে নিয়ে।শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী রুবিনা খান, মেয়ে তানিশা কবীরের যাওয়ার কথা। একই মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নাজমুল হুদা তাঁর স্ত্রী তাহমিনা হক, ছেলে তাহমিদ শামিমকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন। শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হুমায়ুন কবীর বলেন, পরিবারের সদস্যরা নিজেদের খরচে যাচ্ছেন। এতে কোনো সমস্যা নেই।অবশ্য সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী মনে করেন, সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সরকারি সফরে বিদেশে গেলে বেশ কিছু সমস্যা তৈরি হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, স্বজনদের সঙ্গে নিলে সরকারিভাবে যেসব সভা–সেমিনারে অংশ নিতে তাঁরা বিদেশে যান, সেসব কাজ ব্যাহত হয়। এ ছাড়া বিদেশে বেশ কিছু সরকারি আয়োজন থাকে। সেখানে অনেক কর্মকর্তা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে করে নিয়ে যান। এতে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়।জেনেভায় এ সফরে যাচ্ছেন শ্রম মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য নওগাঁ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন ও সংরক্ষিত মহিলা আসন ১৩–এর সংসদ সদস্য শামসুন নাহার। শ্রমসচিব এহছানে এলাহী, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, অগ্রনী ব্যাংক লিমিটেডের সিবিএ সভাপতি নজরুল ইসলাম প্রমুখ। উল্লেখ্য, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। প্রতিমন্ত্রী খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য।‘এটা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়’-সরকারি কর্মচারীদের ঢালাও বিদেশ ভ্রমণে লাগাম টানতে গত বছর একটি পরিপত্র জারি করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়, যা এখনো বহাল আছে। সেখানে বলা হয়েছিল, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশ যাওয়া যাবে না। তবে দেখা যাচ্ছে, করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এখন বিদেশে যাওয়ার মানে হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের সুবিধা দেওয়া। এটা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়। তিনি বলেন, কোনো ধরনের জবাবদিহি না থাকায় এ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।সুত্র-প্রথমআলো  
Link copied!