শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশ্নফাসের রূপার রূপকথার মতো জীবন

প্রকাশিত: ০৯:৩৪ এএম, জানুয়ারি ২৪, ২০২২

প্রশ্নফাসের রূপার রূপকথার মতো জীবন

ডেইলি খবর খবর ডেস্ক: চাকরি প্রত্যাশীদের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত রূপকথার মতো রূপার অপরাধ জীবন। বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার সরকারি দলের নারী ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেত্রী মাহবুবা নাসরিন রূপাকে দলীয় পদ ও সংগঠনের সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে সংগঠন থেকে বহিস্কারেরও সুপারিশ করা হয়েছে। গত রোববার বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।এদিকে,রূপাসহ তার চক্রের ১০ জনকে দু'দিনের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। জনপ্রতিনিধি হয়েও বছর তিনেক ধরে সরকারি-বেসরকারি অন্তত আট প্রতিষ্ঠানের প্রশ্ন ফাঁসে এই চক্র জড়িত। তবে ছাত্রজীবন থেকেই অপরাধে হাতেখড়ি রূপার। রূপার অপরাধ জীবন যেন এক রূপকথার! ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রী থাকাকালে সিট বাণিজ্য ও ছাত্রী নিপীড়নের মতো ঘটনায় তার সংশ্নিষ্টতার অভিযোগ মিলেছে। এ ছাড়া দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে নানা ধরনের তদবির বাণিজ্যও করতেন তিনি। সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে করতেন রকমারি দেনদরবার। রাজনৈতিক পরিচয়, প্রভাব ও অপরাধ চক্রে জড়িয়ে দ্রæত টাকা কামাতে চেয়েছেন রূপা। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সু-সম্পর্কের কারণে দ্রæত বগুড়ার রাজনীতিতেও জায়গা করে নেন তিনি। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, প্রশ্ন ফাঁস এই চক্রের সক্রিয় সদস্য হিসেবে আরও পাঁচ থেকে ছয়জনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারে একাধিক জায়গায় অভিযানও চলছে। তবে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুই মিনিটের মধ্যে তারা প্রশ্ন ফাঁস করতেন, এটা আমাদের বিস্মিত করেছে। কানের ভেতর ছোট্ট ডিভাইস এমনভাবে রাখা হতো, যা বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় ছিল না। ফাঁসকারী চক্রের সদস্যরা পরীক্ষার্থী সেজে হলে ঢুকে বিশেষ আরেক ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র হলের বাইরে চক্রের সদস্যদের কাছে পাঠাতেন। পরে প্রশ্ন সমাধান করে হলের ভেতরে পৌঁছে দিতেন। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তার ১০ জনের বাইরে চক্রে আরও যাদের নাম আসছে, তাদের মধ্যে একজন রেলওয়ের কর্মচারী মো. রোমান। ফারুক ও নোমান নামে আরও দু'জন আছে। এমনকি সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) এক কর্মচারীর নাম পাওয়া গেছে। এ ছাড়া খলিল নামে একজন এই সিন্ডিকেটে যুক্ত। খলিল একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিচ্যুত কর্মী। পলাতক আর বিস্তারিত পরিচয় গ্রেপ্তারের আগে প্রকাশ করতে চাননি ওই কর্মকর্তা।গত শুক্রবার প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ে অডিটর নিয়োগ পরীক্ষা ছিল। ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে রূপাসহ অন্যদের ওইদিনই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। গ্রেপ্তার অন্য ৯ জন হিসাব মহা নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের বরখাস্ত হওয়া সহকারী কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান আজাদ, আল আমিন রনি, নোমান সিদ্দিকী, নাহিদ হাসান, তানজির আহমেদ, শহীদ উল্লাহ, রাজু আহমেদ, রাকিবুল হাসান ও হাসিবুল হাসান। রূপার উত্থান: রূপা দুপচাঁচিয়ার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের ভূঁইপুর গ্রামের আতাউর রহমানের মেয়ে। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে রূপা ছোট। বাবা আতাউর রহমান থাকতেন ঢাকায়। তিনি ছিলেন আজিমপুর গার্লস স্কুলের নৈশপ্রহরী। গ্রামে স্কুলজীবন শেষ করে বাবার চাকরির সুবাদে রূপা ঢাকায় আসেন। ২০০৮-০৯ সেশনে ভর্তি হন ইডেন মহিলা কলেজে। ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরই তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়ান। থাকতেন ইডেনের রাজিয়া হলে। হলের বেশ কয়েকটি কক্ষ নিজের দখলে রাখতেন তিনি। রূপা পর্যায়ক্রমে ইডেন মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক, যুগ্ম আহ্বায়ক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে তিনি ইডেনের হলের সিট বাণিজ্যে নামেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের নাম ভাঙিয়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে তদবির করার কারণে তিনি অনেকের কাছে 'তদবিরকারী নেত্রী' হিসেবে পরিচিত। এক সময় জড়িয়ে পড়েন সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস চক্রে।বগুড়ার রাজনীতিতে যেভাবে এলেন: বগুড়ার আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৮ সালে বগুড়া-৩ আসনে ১৪ দলের পক্ষে জাতীয় পার্টির নেতা নুরুল ইসলাম তালুকদার লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করেন। ওই নির্বাচনে ঢাকা থেকে ৬ থেকে ৭ তরুণ-তরুণীকে এলাকায় নিয়ে তালুকদারের পক্ষে প্রচারণায় নামেন রূপা। প্রচারণা চালিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর থেকে এলাকায় রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয় তার। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার আশীর্বাদ নিয়ে ২০১৯ সালের মার্চে দুপচাঁচিয়া উপজেলা নির্বাচনে নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হন তিনি। প্র্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তার পক্ষে নির্বাচনী কাজে লাগান। ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর প্রভাব খাটিয়ে উপজেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান পদটিও বাগিয়ে নেন। এলাকায় খুব কমই দেখা যায় তাকে। মাঝেমধ্যে আপন ভাই রকিকে নিয়ে এলাকায় গিয়ে থাকেন চাচা দেলোয়ার হোসেনের গোবিন্দপুরের পালিমহেশপুর গ্রামের বাড়িতে।বগুড়ার ভূঁইপুর গ্রামে গিয়ে এলাকার অনেকের সঙ্গে কথা হয়। স্থানীয়রা জানান, রূপাকে তারা চিনতেন না। ২০১৯ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়ে যখন ভোটের মাঠে নামেন,তখন তারা জানতে পারেন রূপা ওই গ্রামের বাসিন্দা।গোবিন্দপুর ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সাখাওয়াত হোসেন মল্লিক বলেন, 'নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর রূপা আমার কাছে আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে রূপা আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আমার দরকার কিনা? উত্তরে আমি বলেছিলাম, আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে চাই।' গোবিন্দপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম পলাশ বলেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। রূপা আমাকে আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়েছিল। সে যখন উপজেলা নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়, তখন এলাকার পাঁচজন মানুষও তাকে চিনত না। তবে নির্বাচনী প্রচারকালে ভালো ভালো বক্তব্য দিয়ে সে এলাকাবাসীর মন জয় করেছিল। দুপচাঁচিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোমিনুর রহমান পলাশ বলেন, 'দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হওয়ায় রূপার মধ্যে এক ধরনের দাম্ভিকতা তৈরি হয়েছিল।' নির্বাচনের পরপরই তিনি বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং পদাধিকার বলে তিনি দুপচাঁচিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগেরও সদস্য হন। তবে তিনি দলীয় কর্মকান্ডে নিয়মিত অংশ নিতেন না। বগুড়ায় না থাকার পরও রূপা কীভাবে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ পেলেন-এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির বগুড়া জেলা কমিটির দপ্তর সম্পাদক আল রাজী জুয়েল বলেন, 'এই প্রশ্নের উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।' স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রূপা ও তার ভাই রকির দাপট রয়েছে এলাকায়। দুপচাঁচিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্যপদ বাগিয়ে নেওয়ার পর ২০২০ সালে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্যও হন রূপা। প্রশ্ন ফাঁসের পরও ফল প্রকাশ:প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ে অডিটর নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের জালিয়াতি ধরা পড়লেও পরীক্ষাটি বাতিল করা হয়নি। প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে গতকাল রোববার এমসিকিউ পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসের তথ্যপ্রমাণসহ জড়িতদের গ্রেপ্তারের পরও পরীক্ষা বাতিল না করে ফল প্রকাশের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।সুত্র-সমকাল,বগুড়া  
Link copied!