শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রশ্ন ব্ল্যাকবোর্ডে উত্তরপত্রের কাগজ শিক্ষার্থীর

প্রকাশিত: ১২:২৮ পিএম, নভেম্বর ১৬, ২০২২

প্রশ্ন ব্ল্যাকবোর্ডে উত্তরপত্রের কাগজ শিক্ষার্থীর

শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে প্রশ্ন লিখে দেওয়া হবে আর বাড়ি থেকে উত্তরপত্র নিয়ে আসবে শিশুরা। এরপর বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেবে। এভাবেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বার্ষিক মূল্যায়ন করতে চায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। দেশে ৬৭ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে তৃতীয় প্রান্তিকে (চূড়ান্ত) বার্ষিক মূল্যায়ন পরীক্ষা শুরু হবে আগামী ৬ ডিসেম্বর। এ পরীক্ষা চলবে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের এ ধরনের আদেশ নিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থের কৃচ্ছ্রসাধনের অনেক ক্ষেত্র আছে। প্রাথমিকের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বয়স ও মানসিক অবস্থায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত ঠিক নয়। শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সবাই জানে। এ জন্যই অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা দিচ্ছে সরকার। বাড়ি থেকে কাগজ এনে পরীক্ষা শিশুর ওপর চাপ বাড়াবে। কেউ ভালো সেলাই করা খাতা নিয়ে আসবে। কেউ ভালো কাগজ কিনে আনবে। শিশুদের মধ্যে বৈষম্য বাড়বে। মানসিক অবস্থায় প্রভাব পড়বে। ফেসবুকে এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক লিখেছেন, ‘জাতির ভবিষ্যৎ কোমলমতি শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে বাড়ি থেকে কাগজ নিয়ে আসবে আর শিক্ষকগণ শ্রেণিকক্ষে বোর্ডে প্রশ্ন লিখে দেবেন। প্রশ্ন কোনোভাবেই ছাপা যাবে না। আর এভাবেই বিপুল অর্থ সাশ্রয়ের মাধ্যমে দেশে তরতর করে উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাবে। সত্যি সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশের প্রশাসন।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, ‘অনেক স্কুলেই ৫শর ওপরে শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। প্রতিটি বিষয়ের ৬০ নম্বরের পরীক্ষা নিতে হবে। বোর্ডে ৬০ নম্বরের প্রশ্ন লিখে পরীক্ষা নেওয়াটা কঠিন হবে। শ্রেণির সব শিক্ষার্থী একসঙ্গে একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। শিক্ষক অন্য একটি প্রশ্ন লেখার জন্য বোর্ড মুছে ফেলবেন। এতে সবাই সমান সুযোগ পাবে না। তাই সঠিক মূল্যায়ন হবে না।’ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের এক আদেশে বলা হয়েছে, ‘বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে প্রশ্নপত্র লিখে মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। কোনো শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অধিক হলে সে ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র হাতে লিখে ফটোকপি করা যেতে পারে। প্রশ্নপত্র ফটোকপির প্রয়োজন হলে বিদ্যালয়ের আনুষঙ্গিক খাত থেকে ব্যয় করা যাবে। কোনো অবস্থাতেই প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন গ্রহণ করা যাবে না। চূড়ান্ত মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক সাদা কাগজ বাড়ি থেকে নিয়ে আসার জন্য পূর্বেই শিক্ষার্থীকে অবহিত করতে হবে।’ এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘তৃতীয় প্রান্তিকে প্রতি শ্রেণিতে প্রতি বিষয়ে সর্বোচ্চ ৬০ নম্বরের মধ্যে বার্ষিক মূল্যায়ন সম্পন্ন করতে হবে। প্রশ্নপত্র প্রণয়নে জ্ঞানমূলক, অনুধাবন, প্রয়োগমূলক, শিখন ক্ষেত্র বিবেচনায় নিতে হবে। মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য শিক্ষার্থী বা অভিভাবকগণের কাছ থেকে কোনো মূল্যায়ন ফি গ্রহণ করা যাবে না।’ বিগত বছরগুলোতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কীভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে পরীক্ষা নেওয়া হতো এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর পাশর্^বর্তী এক উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যার ভিত্তিতে বার্ষিক উন্নয়ন ফান্ড দেওয়া হয়। স্কুল লেভেল ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যানের আওতায় ২০০ শিক্ষার্থীর বেশি স্কুলগুলোতে বছরে ৭০ হাজার টাকা, ২০০ শিক্ষার্থীর কম স্কুলে ৫০ হাজার টাকা এবং ৫০০ শিক্ষার্থীর অধিক স্কুলে ৮০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা বিদ্যালয়ে বছরে তিনটি সাময়িক পরীক্ষা নেওয়া হয়। বিগত বছরগুলোতে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের সমন্বয়ে প্রশ্ন তৈরি, মডারেশন ও প্রশ্ন ছাপানো হতো। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট উপজেলার স্কুলগুলোতে প্রশ্ন পাঠাত। স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষার উত্তরপত্রের খাতা বানাত। এভাবেই দীর্ঘদিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হতো। উন্নয়ন ফান্ড থেকেই এ ধরনের খরচ মেটানো হতো। তিনি আরও জানান, করোনা মহামারির পূর্বে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের নতুন নির্দেশনায় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানের বদলে স্ব স্ব স্কুলের ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষা ছেড়ে দেয়। এতে স্কুলগুলো প্রশ্নপত্র তৈরি, মডারেশন ও প্রশ্ন ছাপিয়ে পরীক্ষা গ্রহণ করে। ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। করোনায় শনাক্ত ও মৃত্যু বেড়ে গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। করোনাকালে গত তিন বছরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সশরীরে পরীক্ষা নিয়ে মূল্যায়ন করা হয়নি। করোনার পর প্রথমবার প্রাথমিকে চূড়ান্ত মূল্যায়নে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী ফারুক হোসেন বলেন, ‘প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের বয়স কম, মানসিক অবস্থা ভিন্ন। বাড়ি থেকে কাগজ এনে পরীক্ষা দেওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এ ছাড়া বাড়ি থেকে খাতা নিয়ে আসাটাও একটি বৈষম্য সৃষ্টি করবে।’ তিনি বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থী ভালো বাঁধাই, ভালো কাগজ নিয়ে আসবে। অনেকে হয়তো পারবে না। এটা শিশুদের মানসিক চাপ বাড়াবে। তারা চূড়ান্ত মূল্যায়নে খারাপ করবে।’ কাজী ফারুক হোসেন বলেন, আর্থিক কৃচ্ছ্রসাধনের অনেক ক্ষেত্র আছে। বোর্ডে প্রশ্ন লিখে দেওয়াটা দোষের কিছু না হলেও বাড়ি থেকে কাগজ নিয়ে আসার সিদ্ধান্তটা ঠিক নয়। চূড়ান্ত মূল্যায়নে অন্যভাবে সৃজনশীল চিন্তা করা যেত বলে মনে করেন তিনি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, ‘আমাদের টাকা নেই, তাই পরীক্ষার খাতা বাড়ি থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসতে হবে। টাইপ করা প্রশ্নপত্র ফটোকপি করে পরীক্ষা নেওয়া হবে।’ বোর্ডে প্রশ্ন লিখতে হবে না উল্লেখ করে তিনি জানান, বোর্ডে লেখার বিষয়টি পরিবর্তন করে নতুন আদেশ জারি করা হবে। শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবৈতনিক, আমরা স্কুলে পরীক্ষার ফি নিতে চাই না। আগে টাকা ছিল স্কুল থেকে পরীক্ষার খাতা দেওয়া হতো।’
Link copied!