শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফিরতি যাত্রায়ও সেই একই দৃশ্য

প্রকাশিত: ০৭:৪২ এএম, মে ১৭, ২০২১

ফিরতি যাত্রায়ও সেই একই দৃশ্য

আনন্দমাখা কিছু সুখস্মৃতি মানসপটে আঁকা তো হয়েই গেল! ঈদ শেষ, ছুটিও ফুরিয়েছে। গ্রামের স্নিগ্ধতা ফেলে এবার কংক্রিটের নগরে ফেরার পালা। তবে গেল সপ্তাহে নাড়ির টানে ঈদযাত্রা যে রকম ঘাম ঝরানো ছিল, ফিরতি যাত্রার ছবিও একই। রাজধানীর বুকে পা ফেলতে এবারও পাড়ি দিতে হচ্ছে বন্ধুর পথ! তবে মনের সন্তুষ্টি এটুকুই, ঈদে স্বজন-বান্ধবদের সঙ্গে কাটানো কিছু রঙিন সময় রইল পুঁজি হয়ে। এই সন্তুষ্টি ঢাকাফেরত মানুষকে রসদ জোগাবে পরের ঈদ অবধি। ঢাকার পথে ফিরতি যাত্রায় রাস্তায় নেমেই সেই চেনা বিড়ম্বনায় ঈদে গ্রামে যাওয়া মানুষ। করোনায় কঠোর বিধি-নিষেধের কারণে দূরপাল্লার বাস বন্ধ, চলছে না ট্রেন-লঞ্চ। বিভিন্ন জেলা সীমানা থেকে যানবাহন বদলে বদলে ঢাকায় ফিরছে জনস্রোত। তবে স্বাস্থ্যবিধি উঠেছে শিকায়। মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, ছোট ট্রাক, পিকআপ ভ্যান ও সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে ঢাকায় ফিরতে গিয়ে যাত্রীদের পকেট কাটা পড়ছে বারবার। অতিরিক্ত ভাড়া তিন থেকে চার গুণে গিয়েও ঠেকছে। গতকাল রবিবার রাজধানীর আমিনবাজার, গাবতলী, আব্দুল্লাহপুর এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় ঢাকায় ফেরা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এই দুর্দশার তথ্য মিলেছে। এদিকে ঈদের দ্বিতীয় দিনেও গতকাল শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে উভয়মুখী যাত্রীর ভিড় ছিল। একই সঙ্গে ঢাকা ও দক্ষিণবঙ্গমুখী যাত্রীর চাপে পড়ে ফেরি কর্তৃপক্ষ রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। ফেরিগুলো ভরে যেমন যাত্রী যাচ্ছে দক্ষিণবঙ্গের দিকে, তেমনি দক্ষিণবঙ্গ থেকেও ফেরি ভরে ঢাকার দিকে যাত্রী ফিরছে। এদিকে এবারের ঈদে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে যাত্রী ও মালবাহী যানবাহন চলাচল অতীতের রেকর্ড ভেঙেছে। বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধনের পর গত ২৩ বছরের মধ্যে এ বছরই সেতু দিয়ে সর্বোচ্চসংখ্যক যানবাহন পারাপার হয়েছে। রাজধানীর প্রবেশমুখ : গতকাল ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, যেসব যাত্রী ফিরছে তাদের বেশির ভাগই একক যাত্রী। পরিবার নিয়ে ফেরা যাত্রীর সংখ্যা কম। সকাল ১০টার দিকে গাবতলী বাস টার্মিনালের বিপরীত পাশের সড়কে এক মোটরসাইকেলচালকের সঙ্গে যাত্রীর তর্কবিতর্ক নজরে আসে। ঢাকায় বিদেশিদের পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন কুষ্টিয়ার আরিফুল হক। পাটুরিয়া ঘাট থেকে তিনি এক হাজার টাকায় মোটরসাইকেল ভাড়া করেছেন ঢাকার গুলশানে যাবেন বলে। মোটরসাইকেলচালক তাঁকে নামিয়ে দিয়েছেন গাবতলী। এ নিয়েই উভয়ের বিতণ্ডা। মোটরসাইকেলচালক সুমনের যুক্তি, ঢাকা শহরের ভেতরে ঢুকলে পুলিশ তাঁর মোটরসাইকেল আটকে দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত আরিফুল বাস ধরেই গুলশানের দিকে রওনা হন। আমিনবাজারে এমন একাধিক যাত্রীর সঙ্গে কথা হয়, যারা একাই ঢাকা ফিরেছে। ঝিনাইদহের যুবক নজিব আহমেদ বলেন, স্ত্রী ও সন্তানকে বাড়ি রেখে এসেছি। লকডাউন উঠলে নিয়ে আসব। প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসে আসা যাত্রীরা ঢাকার প্রবেশমুখের পরিবর্তে শহরের মধ্যে নিজ নিজ গন্তব্যে এসে পৌঁছছে। অন্যদিকে মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যান, ট্রাক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশায় আসা যাত্রীদের ঢাকার প্রবেশমুখেই নামতে হচ্ছে। এসব যাত্রী কিছুটা হেঁটে বাসে উঠছে। অন্যদিকে প্রায় ঈদের আগের মতোই গতকাল ঢাকা ছাড়তে দেখা গেছে অনেক পরিবারকে। আমিনবাজার থেকে পরিবার নিয়ে পাটুরিয়ার বাসে ওঠা যাত্রী মাগুরার সোহেল বলেন, ‘ঈদের আগে ঝুঁকি বেশি বলে গ্রামে যাইনি। মনে করেছিলাম ঈদের পর লকডাউন হয়তো তুলে দিতে পারে। এখন বাধ্য হয়ে যাচ্ছি। বড় ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে, না গেলে পরিবারে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হবে।’ শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে উভয়মুখী যাত্রীর ভিড় : শিমুলিয়া ঘাটে গতকাল গিয়ে দেখা যায়, ভোরে যাত্রীর চাপ কিছুটা কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাপ বাড়তে থাকে। যাত্রীর চাপ নিয়ন্ত্রণে ১৬টি ফেরি চলাচল করেছে। পাশাপাশি পুলিশ, নৌ পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস সতর্ক অবস্থানে ছিল। কেউ কেউ ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফিরছিল, আবার কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামের বাড়ি ছুটছিল। তবে দুপুরের পর ঘাটের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। সকালের দিকে শিমুলিয়া ঘাট থেকে কয়েকটি যাত্রীবাহী বাস ছেড়ে যেতে দেখা যায়। তবে তা কিছু সময় পর বন্ধ হয়ে যায়। যাত্রীরা ফেরি পার হয়ে শিমুলিয়া ঘাটে এসে অটোরিকশা, পিকআপ, ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন গাড়িতে করে ঢাকার উদ্দেশে শিমুলিয়া ঘাট ছাড়ছিল। যে যেভাবে পারছে ছুটছে। ১০০ টাকার ভাড়া ৭০০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। ঘাটসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখন উভয়মুখী যাত্রীর চাপ রয়েছে। ঈদের পর গত শনিবার থেকে এই উভয়মুখী চাপ তৈরি হয়। গতকাল যাত্রীর চাপ আরো বাড়ে মাওয়া ও শিমুলিয়া ঘাটে। বিআইডাব্লিউটিসি শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সাফায়েত আহমেদ জানান, যাত্রীর চাপ বেড়েছে কয়েক গুণ। যানবাহন ও যাত্রীদের নির্বিঘ্ন পারাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে যান চলাচলে রেকর্ড : করোনা সংক্রমণ রোধে কঠোর বিধি-নিষেধ থাকার পরও এবারের ঈদে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে যাত্রী ও মালবাহী যানবাহন চলাচলে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধনের পর গত ২৩ বছরের মধ্যে এ বছরই সেতু দিয়ে সর্বোচ্চসংখ্যক যানবাহন পারাপার হয়েছে বলে জানিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। সেতু কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঈদের এক দিন আগে গত বুধবার ২৪ ঘণ্টার হিসাবে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে মোট ৫২ হাজার ৬৬৭টি যানবাহন পার হয়। এর মধ্যে রয়েছে মোটরসাইকেল ১৩ হাজার ৫৬টি, প্রাইভেট কার ২৩ হাজার ৪৮৪, পণ্যবাহী ট্রাক পাঁচ হাজার ৩৫৫, ছোট ট্রাক তিন হাজার ৬৭৪, মাঝারি ট্রাক তিন হাজার ২৭২, বড় বাস তিন হাজার ৭৬৬ এবং ছোট বাস ৭০টি। এ থেকে মোট রাজস্ব আয় হয় দুই কোটি ৯৯ লাখ ১৮ হাজার ৪০ টাকা, যা সেতু নির্মাণ হওয়ার পর সর্বোচ্চ রাজস্ব আয়। এর আগে গত বছরের ৩০ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৩১ জুলাই অর্থাৎ ঈদুল আজহার আগের দিন সকাল ৬টা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ৪৮ হাজার ৩২১টি যানবাহন পার হয়। এর মধ্যে ঢাকা থেকে যাত্রী ও মালপত্র নিয়ে উত্তরাঞ্চলের দিকে এসেছে ৩২ হাজার ৮৫টি যানবাহন এবং উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকার দিকে ফিরেছে ১৬ হাজার ২৩৬টি যানবাহন। দুই ফেরিতে পাঁচ যাত্রীর মৃত্যু : গত বুধবার শিমুলিয়া থেকে বাংলাবাজার যাওয়ার পথে দুই ফেরিতে প্রচণ্ড গরম ও হুড়াহুড়িতে দম বন্ধ হয়ে পাঁচ যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। এ সময় দুই ফেরির শতাধিক যাত্রী অসুস্থ হয়। মারা যাওয়া যাত্রীরা হলো গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর পদ্মবিল গ্রামের মজিবর রহমান শেখের মেয়ে শিল্পী বেগম (৪০), পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির আরামকাঠি গ্রামের আব্দুল জব্বারের ছেলে মো. শরিফুল ইসলাম (২৬), মাদারীপুরের কালকিনির গোপালপুর ইউনিয়নের বালীগ্রাম এলাকার আল আমিন বেপারীর স্ত্রী নিপা বেগম (৪০) ও বরিশালের মুলাদীর চরকালেকাং গ্রামের ইসহাক আকন্দের ছেলে মো. নুরউদ্দিন (৪৫) ও শরীয়তপুরের নড়িয়ার কলিকা প্রসাদ গ্রামের গিয়াস উদ্দিন মাদবরের ছেলে আনসুর মাদবর (১৫)।
Link copied!