বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফের আলোচনায় ‘ধর্মব্যবসায়ীরা’, শ্বেতপত্র নিয়ে বিতর্ক

প্রকাশিত: ০৯:৪৩ এএম, মে ১৩, ২০২২

ফের আলোচনায় ‘ধর্মব্যবসায়ীরা’, শ্বেতপত্র নিয়ে বিতর্ক

মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে জড়িত বিতর্কিত ১১৬ ধর্মীয় বক্তা ও ১ হাজার মাদ্রাসার নামের তালিকাসংবলিত ‘শ্বেতপত্র’ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দেওয়ার পর থেকে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছেই। শ্বেতপত্র দেওয়া গণকমিশনের সদস্যরা বলছেন, তারা ধর্মীয় আলোচনা চান। তবে তা হতে হবে গঠনমূলক। কোনো উসকানিমূলক ও নারীবিদ্বেষী বয়ান চলতে পারে না, যা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। সব নয়, যেসব মাদ্রাসা জঙ্গিবাদী ও মৌলবাদী কাজে লিপ্ত সেগুলোকে অর্থনৈতিক জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি। আর ধর্মীয় সংগঠনগুলো গণকমিশনের শ্বেতপত্রকে সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা আখ্যা দিয়ে বলছে, ওই কমিশনই মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির ভূমিকা নিয়েছে। তবে দুদক বলছে, আর্থিক এখতিয়ারভুক্ত বা মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত যে অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করবে। দুদকের পাশাপাশি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেও ওই শ্বেতপত্র জমা দিয়েছে দেশের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত গণকমিশন। চিহ্নিত ১১৬ ‘ধর্ম ব্যবসায়ীর’ বিরুদ্ধে সারা দেশে মৌলবাদী তৎপরতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সমাজে উসকানি ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ করা হয়েছে এ শ্বেতপত্রে। গণকমিশনের চেয়ারপারসন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বে কমিশনের উচ্চপর্যায়ের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বুধবার দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ও মানবাধিকার কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের হাতে ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন’ শীর্ষক ২ হাজার ২০০ পৃষ্ঠার এ শ্বেতপত্র তুলে দেন। অপরাধ তদন্ত করে এই ‘ধর্ম ব্যবসায়ী’ ও মাদ্রাসাগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে গণকমিশনের শ্বেতপত্রে। এ বিষয়ে গণকমিশনের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, শ্বেতপত্রে নাম ওঠা ওইসব বক্তার অর্থের উৎস জানতে চাই। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জবাবদিহি ও নজরদারির আওতায় আনা জরুরি মনে করছি। তারা এত টাকা খরচা করে সমাজে গুজব ও উসকানি ছড়িয়ে দিচ্ছে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কাজে ব্যবহার করছে তারা। সেগুলোতে হেফাজতের কর্মকাণ্ড উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ইসলামে ধর্মের আলোচনা থাকবেই। আমরা ধর্মীয় আলোচনা চাই। কিন্তু বিতর্কিত বক্তাদের নিষিদ্ধ চাই। তারা বিভেদ সৃষ্টি করছেন। ওই ধর্মীয় বক্তারা নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন, তাই কমিশনে জমা দিয়েছি। প্রায় এক বছর আমরা মাঠপর্যায়ে গিয়ে এ শ্বেতপত্র করেছি। এমনকি মাদ্রাসাছাত্রের সঙ্গেও কথা বলেছি। ৩০ সদস্যের কমিটি কাজ করেছি। অফিসে কাজ করেছেন ৪২ জন। সমাজকর্মী খুশি কবীরের মতে, এভাবে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিতর্কিত বেফাঁস বক্তব্য চলতে পারে না। অনেক বক্তার খুতবা ও ওয়াজ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, ওইসব বক্তার বক্তব্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। নারীবিদ্বেষী বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের উসকানিমূলক সাম্প্রদায়িক বক্তব্য নারীকে নিরাপত্তাহীন করে তুলছে। পুরুষদের মানসিকভাবে বিকৃত করছে। ফেসবুকে একটি পোস্টের কারণে যদি কাউকে আটক করা হয় তাহলে বেফাঁস বক্তব্য দেওয়া ধর্মীয় বক্তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। গণকমিশনের চেয়ারপারসন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক জানান, তাদের শে^তপত্রে বহু ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। তদন্তে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। জঙ্গিবাদ ছড়াতে জামায়াতে ইসলামী ও ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে অর্থায়ন করার তথ্যও মিলেছে। তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা ও দুর্নীতির তথ্য দুদকে জমা দেওয়া হয়েছে। তাদের আর বাড়তে দেওয়া যায় না। দেশের বিভিন্ন স্থানের ডিসি, এসপি, ইউএনওসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে এ শ্বেতপত্রে জানানো হয়েছে, তারা মৌলবাদী ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে উসকানি দিচ্ছেন। তিনি জানান, অর্ধশতাধিক ‘ওয়াজ’ ব্যবসায়ীর দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। শ্বেতপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুদক আইন অনুযায়ী অপরাধীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে। জেলে আটক মাওলানা মামুনুল হকসহ যারা মৌলবাদী তৎপরতা ও ধর্মীয় সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলমান। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও গণকমিশনের সমন্বয়ক কাজী মুকুল বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ শ্বেতপত্র তৈরি করা হয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, মৌলবাদী গোষ্ঠীর অর্থপ্রবাহ চলমান রয়েছে। এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভারপ্রাপ্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান বলেন, বুধবার নথিপত্রগুলো দুদকের কাছে দেওয়া হয়েছে। সেখানে ২২০০ পৃষ্ঠার বিশাল নথি। এর মধ্যে যা দুদকের এখতিয়ারভুক্ত বা তফসিলভুক্ত থাকবে, সেগুলো নিয়ে কাজ করবে দুদক। তিনি আরও বলেন, এত দ্রুতই কোনো পদক্ষেপের বিষয়ে বলা যাবে না। তাদের তালিকায় দুদকের এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট অপরাধের উল্লেখ থাকলেও এখতিয়ারবহির্ভূত অপরাধের বিবরণ বেশি রয়েছে। এর মধ্যে আর্থিক এখতিয়ারভুক্ত বা মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত যে অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করবে দুদক। ইতোমধ্যে নথিগুলো পর্যালোচনা করে অর্থ সংক্রান্ত বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। আরও কয়েকদিন গেলে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা সম্ভব হবে। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি এবং জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক ককাসের যৌথ উদ্যোগে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন’। গত ১২ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আনুষ্ঠানিকভাবে শ্বেতপত্রের মোড়ক উন্মোচন করেন। এতে ১১৬ জনের মধ্যে হেফাজতসহ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠনের নেতার নাম উল্লেখ রয়েছে। এ ঘটনায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বলেছে, এ সংগঠনটি বরাবরের মতোই নিজেদের ইসলামবিদ্বেষী চেহারা জাতির সামনে উন্মোচন করেছে। তাদের শ্বেতপত্র সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং মিথ্যা তথ্যে ভরপুর। বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে হেফাজতে আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, শাহবাগী সংগঠন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই নানাভাবে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার পাঁয়তারা চালিয়ে আসছে। সর্বশেষ তারা দেশবরেণ্য ওলামা-মাশায়েখ এবং ইসলামী আলোচকদের এ তালিকা প্রকাশ করে চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। আমিরে হেফাজত কঠিন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, সরকার যদি এখনই শক্ত হাতে তথাকথিত এই ভুঁইফোঁড় সংগঠনকে দমন না করে তাহলে ইসলামপ্রিয় আপামর তৌহিদি জনতা কঠোর আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে। হেফাজতের বিবৃতির পর পাল্টা বিবৃতি দেয় গণকমিশন। বিবৃতিতে বলা হয়, অভিযোগ প্রমাণ-অপ্রমাণের আগে হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালের মে মাসের মতো যে ভয়ঙ্কর ভাষায় হুমকি দিয়েছে, তা তাদের বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্তের অন্তর্গত। তাদের হুমকিসংবলিত বিবৃতিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। প্রতিবেদন: সাব্বির আহমেদ, সময়ের আলো।
Link copied!