শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাজেট সহায়তায় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ’র কাছ থেকে ৫.৫ বিলিয়ন ডলার আশা করছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:১০ এএম, জুন ২৯, ২০২২

বাজেট সহায়তায় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ’র কাছ থেকে ৫.৫ বিলিয়ন ডলার আশা করছে বাংলাদেশ

ডেইলি খবর ডেস্ক: বাজেট সহায়তায় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ’র কাছ থেকে ৫.৫ বিলিয়ন ডলার আশা করছে বাংলাদেশ। এবারের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট সহায়তায় বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে প্রথমবারের মতো সুদ মুক্ত সুবিধায় ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ পাবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ- যা দেশের ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে সহায়তা দেবে। একইসঙ্গে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টে সহায়তা হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে স্বল্প সুদে ৪.৫ ডলার বিলিয়ন ডলার নেওয়ার আলোচনাও শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আগামী তিন বছরে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক এ দুটি ঋণসংস্থা থেকে সরকার এভাবে অন্তত ৫.৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। আইএমএফ-এর ঋণ নেওয়ার বিষয়ে সংস্থাটির বাংলাদেশ প্রতিনিধির সঙ্গে বুধবার (২৯ জুন) ভার্চুয়াল বৈঠকে বসবেন অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) শীর্ষ কর্মকর্তারা। এতে যোগ দেবেন- অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার, ইআরডি সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শরীফা খাতুন।নাম না প্রকাশের শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন,আগামী ১২ জুলাই আইএমএফ- এর একটি মিশন ঋণ নিয়ে আলোচনা করতে বাংলাদেশে আসবে। তার আগে আইএমএফ ঋণের শর্তগুলোর বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে সংস্থাটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়।এসব আনুষ্ঠানিকতা শেষে চুক্তি স্বাক্ষর হতে কমপক্ষে ৬ মাস লাগতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।বিশ্বজুড়ে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়া এবং রপ্তানির তুলনায় আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের 'ব্যালেন্স অব পেমেন্ট' এবং 'কারেন্ট একাউন্ট' ভারসাম্যে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে, ডলারের বিপরীতে টাকার মান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতিও গত আট বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা পরিস্থিতি নেমে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, এতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমে যাবে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৭.৫৭ বিলিয়ন ডলার এবং একই সময়ে চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ১৫.৩২ বিলিয়ন ডলার। মুদ্রা বাজারে ডলারের সংকট মেটাতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বাজারে ছেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার।ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, চলমান অনিশ্চিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আগামী তিন বছর ধরে সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে আইএমএফ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলায় শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানও আইএমএফ থেকে বাজেট সহায়তা নিচ্ছে। এ সহায়তা পাওয়ার পর আইএমএফ এর শর্ত পূরণ করতে গিয়ে উভয় দেশকে জ্বালানি তেলের ভর্তুকি প্রত্যাহার করে দাম বাড়াতে হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম ৫০০ রূপি হয়েছে। পাকিস্তানেও দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। আ্ইএমএফ বাংলাদেশকে জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের ভর্তুকি প্রত্যাহারের মতো শর্তারোপ করবে না উল্লেখ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তাান ও শ্রীলঙ্কার তুলনায় অনেক ভালো এবং আমাদের ভর্তুকির পরিমাণ জিডিপির তুলনায় বেশ কম।বাংলাদেশের জন্য আইএমএফ- এর সহায়তার শর্তাবলী সম্পর্কে জানতে চাইলে ইআরডির একজন জেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, এগুলো এখনও নির্ধারিত হয়নি। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে সংস্কার বাস্তবায়ন, নন-পারফর্মিং ঋণ কমানো, স্থানীয় ঋণ বাজারের জন্য পুঁজি বাজারের উন্নয়ন এবং আর্থিক, অর্থ-বাৎসরিক ও অর্থায়নে গভর্ন্যান্সের উন্নতি এসব ঋণ প্রস্তাবের সাথে যুক্ত থাকার অনুমান করা হচ্ছে। এছাড়া আর্থিক নীতিমালার কাঠামো আধুনিকীকরণ,অর্থ-বার্ষিক কাঠামো উন্নতিকরণ ও আর্থিক ঝুঁকি কমানো, আর্থ-বার্ষিক নীতিতে প্রবৃদ্ধি সহায়ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যয়ের সুযোগ রাখা, সমস্যা চিহ্নিতের মাধ্যমে আর্থিক দুর্বলতাগুলি কমানো, নজরদারি শক্তিশালীকরণ,তথ্য-উপাত্তের মান উন্নয়ন এবং জলবায়ু সংক্রান্ত দুর্বলতাগুলি কমাতে সংস্কার বাস্তবায়নের মতো বৃহত্তর অনেক বিষয়াদি এর সাথে যুক্ত থাকতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বাংলাদেশ এর আগে তিনবার আইএমএফ থেকে বাজেট সহায়তা নিয়েছে উল্লেখ করে অর্থবিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, ১৯৯১-১৯৯২ সালের দিকে প্রথমবার নেওয়া হয়। দ্বিতীয়বার, ২০১২ সালে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান অনেক কমে যাওয়ায় ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঘাটতি মেটাতে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা নেয় সরকার। ওই সময় আইএমএফ'র শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে বহুল আলোচিত নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন করে সরকার। পরে কোভিডকালীন সময়ে বাজেট সহায়তা হিসেবে আইএমএফ থেকে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে সরকার। এ সময় তেমন কোনো শর্তারোপ করেনি সংস্থাটি।ইআরডি ও অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, আইএমএফ'র যেকোনো একটি ঋণ কর্মসূচি থেকে এত বেশি ঋণ পাওয়ার সুযোগ না থাকায় সংস্থাটির তিনটি কর্মসূচি থেকে ঋণ নেওয়া হবে। এর মধ্যে- এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটিজ (ইসিএফ), এক্সটেনডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলার জন্য গঠিত রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাস্টেইনেবিলিটি ফান্ড (আরএসএফ) প্রোগ্রাম থেকে ঋণ নেওয়া হবে। এর মধ্যে ইসিএফ থেকে নেওয়া ঋণের কোনও সুদ নেই, এমনকী কোন সার্ভিস চার্জও দিতে হবে না। ১০ বছর মেয়াদি এই ঋণ পরিশোধে ৫.৫ বছর গ্রেস পিরিয়ড পাবে বাংলাদেশ। অন্যদুটি প্যাকেজের সুদহার ১.৫৪ থেকে ১.৭৯ শতাংশের মতো ভিন্ন ভিন্ন।সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট- এর নির্বাহী পরিচালক ড.আহসান এইচ মনসুর বলেন, সংস্কারের ব্যাপারে সরকার যদি মনোযোগ হয়, তাহলে দেশে সংকট দেখা দেওয়ার আগেই আইএফএফ থেকে বাজেট সহায়তা পাওয়া যাবে। তবে সংকট শুরু হয়ে গেলে সহায়তা পাওয়া তখন কঠিন হবে।তিনি বলেন,আইএমএফ এতো বিপুল পরিমাণ অর্থ সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সংস্কারের শর্তারোপ করবে, যা বাস্তবায়নে সরকারের রাজনৈতিক সম্মতি প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশে অনেক বছর ধরেই কোনো সংস্কার হচ্ছে না। এবারই সংস্কারের শেষ সুযোগ,পরের বছর নির্বাচন থাকায় তখন সরকারের পক্ষে সংস্কার করা সম্ভব হবে না।'আইএমএফ থেকে বাজেট সাপোর্ট পেলে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থাও বাজেট সাপোর্ট দিতে এগিয়ে আসবে। এ সুযোগ নিতে পারলে সত্যিকার অর্থেই দেশের জন্য অনেক ভালো হবে'- যোগ করেন তিনি। বিশ্বব্যাংকের ঋণের নতুন সুযোগ- মহামারির অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে এবারই প্রথম বাংলাদেশের মতো নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশকে নতুন শর্ট ম্যাচিউরিটি লোন (এসএমএল) উইন্ডো থেকে সুদ মুক্ত ঋণ নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। তিন বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০তম ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট রিপ্লেনিশমেন্ট (আইডিএ-২০) প্যাকেজের জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৫ সময়ের মধ্যে এ ঋণ নিতে হবে। ১২ বছর মেয়াদি এই ঋণের গ্রেস পিরিয়ড ৬ বছর। ইআরডি কর্মকর্তারা জানান,আইডিএ সদস্য দেশের তাদের জন্য নির্ধারিত আইডিএ-২০ প্যাকেজের ২৫% শর্ট ম্যাচিউরিটি ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইডিএ গ্রিন, আইডিএ- জিএপি এবং আইডিএ মিশ্র দেশও সুদ মুক্ত এ ঋণের সুবিধা পাবে। শুধুমাত্র আইডিএ রেড ক্যাটাগরি দেশ যারা ঋণ পরিশোধে ভালো অবস্থানে নেই, তারা এ সুযোগ পাবে না। কোভিড পরিস্থিতিতে বিশেষ বিবেচনায় বিশ্ববাংক আইডিএ সদস্য দেশগুলোর জন্য এ সুযোগ দিচ্ছে।আইডিএ-২০ প্যাকেজের সীমা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। তবে আইডি-১৯ এ বাংলাদেশের জন্য ঋণসীমা (সিলিং) ছিল ৪.২ বিলিয়ন ডলার। তাই সাম্পতিক অর্থায়ন প্যাকেজে বাংলাদেশের সিলিং ৪ বিলিয়ন ডলারের কম হবে না। ফলে বাংলাদেশ সুদ মুক্ত ঋণ পাবে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি-উল্লেখ করেন তারা। আগামী জুলাই থেকে আইডিএ-২০ শুরু হবে। ফলে দ্রæত সুদ মুক্ত ঋণ নেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করেছে বাংলাদেশ। কারণ প্রথম দিকে অর্থ নিয়ে ব্যয় করা গেলে, পরে যেসব আইডিএ সদস্য দেশ এ ধরনের ঋণ ব্যবহার করতে পারবে না, তাদের একটা অংশও বিনা সুদে ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। সুত্র-টিবিসি
Link copied!