শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাপ-বেটার ৩৯ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৮:৪৭ এএম, অক্টোবর ১৬, ২০২১

বাপ-বেটার ৩৯ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ

ডেইলি খবর ডেস্ক: বাপ-বেটার দুর্নীতি ৩৯ কোটি টাকা। বেসরকারি লিডিং ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) চেয়ারম্যান শিল্পপতি রাগিব আলী। তার ছেলে সৈয়দ আব্দুল হাই এ বোর্ডের সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে পাঁচ কোটি ৬৬ লাখ ১৮ হাজার ২৪৩ টাকা নিয়ে পরিশোধ করা হয় এই দুজনের ব্যক্তিগত আয়কর। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এই তথ্য। ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী সাধারণ তহবিলের টাকা এভাবে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যয়ের সুযোগ নেই। কিন্তু বাপ-বেটা তা করেছেন। গত ২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্থাটির অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে,বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি কেনা থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের পরিবহণের জন্য বাস ভাড়া করার ক্ষেত্রেও অর্থ ব্যয়ে পদে পদে আছে অনিয়ম। বিভিন্ন সময়ে কর আদায়যোগ্য ব্যয়েও তা (কর) আদায় করা হয়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ব্যয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অনুমোদন নেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এভাবে প্রায় ৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনায়ও আইন লঙ্ঘন করা হয়। তবে অনিয়মের ব্যয়ে কোনো অর্থ লুটপাট হয়েছে কিনা-সেই তথ্য বের করতে পারেনি ইউজিসি। তাই সেই তথ্য বের করতে সংস্থাটি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং দুর্নীতি কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে অনুসন্ধানের সুপারিশ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। পাশাপাশি সুপারিশ করা হয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার। প্রতিবেদনটি বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।এ প্রসঙ্গে তদন্ত দলের প্রধান ও ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড.আবু তাহের বলেন,বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলে শিক্ষার্থীদের টিউশনসহ বিভিন্ন উৎস থেকে আয়ের অর্থ থাকে। সেই অর্থে কারও ব্যক্তিগত আয়কর দেয়ার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে কী ঘটেছে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেন,আমাদের কাজ তথ্য অনুসন্ধান করা। আর ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের।জানা গেছে,প্রতিবেদনে তথ্য-উদঘাটন আর সুপারিশের ব্যাপারে খোদ ইউজিসির ভেতরে উষ্মা আছে। নাম প্রকাশ না করে দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানান,অর্থ ব্যয়সংক্রান্ত দুর্নীতি ও লুটপাটের তথ্য কমিটি বের করতে পারেনি। কেবল বিভিন্ন বিষয়ের উপরিভাগে ঘোরাফেরা করা হয়েছে। যে কারণে অর্থ ব্যয়ে আইনগত কী ব্যত্যয় ঘটেছে বা অনিয়ম হয়েছে,তা চিহ্নিত করলেও বেআইনি ব্যয়ে আইনের কোন ধারা লঙ্ঘন করা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। অথচ স্থায়ী সনদ গ্রহণ না করায় আইনের কোন ধারা লঙ্ঘিত হচ্ছে সেটি উল্লেখের কথা আছে এতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় গত বছরের ২৪ অক্টোবর পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে ইউজিসি। পরে এ বছরের ৬ ফেব্রæয়ারি কমিটিতে আরেক সদস্য বাড়ানো হয়। এ কমিটির নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির সদস্য অধ্যাপক ড.আবু তাহের।কমিটি প্রাথমিকভাবে ভুয়া ভাউচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পৌনে ৭৭ কোটি টাকা উত্তোলনের অভিযোগ সামনে রেখে তদন্তে নামে। কমিটি প্রথমে ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিল,এফডিআরসহ অর্থ ও হিসাবসংক্রান্ত তথ্যাদি তলব করে। মোট তিন দফায় এসব তথ্য চাওয়ার পর গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর তথ্য দেওয়া হয়। চূড়ান্ত তদন্তে ৩৮ কোটি ৮৪ লাখ ৬৭৪ টাকা ব্যয়ে অনিয়মের তথ্য বের করতে সক্ষম হয় কমিটি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে বিওটির চেয়ারম্যান রাগিব আলী এবং তার পুত্র (বিওটি সদস্য) আবদুল হাইয়ের ব্যক্তিগত আয়কর পরিশোধের জন্য পাঁচ কোটি ৬৬ লাখ ১৮ হাজার ২৪৩ টাকা উত্তোলন করা হয়। কিন্তু এর কোনো প্রমাণপত্র বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাখিল করেনি। আইনের ৪৪(৭) ধারা অনুযায়ী সাধারণ তহবিলের টাকা এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশে ব্যয়ের কোনো সুযোগ নেই। অভিযোগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী সরকার ও ইউজিসিকে অবহিত করে সাধারণ তহবিলের অর্থ ব্যয় বা এফডিআর করা যাবে। কিন্তু আইনের ৪৪(৩) ধারা লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রীদের জন্য পরিবহন খাতে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২১ কোটি পৌনে ১২ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। সংরক্ষিত তহবিলের ব্যাংক স্টেটমেন্টের বিস্তাারিত বিবরণী পাওয়া যায়নি। কেবল ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত একটি বিবরণী (৮ কোটি ৭ লাখ ৬৮ হাজার) দেওয়া হয়েছে। উপাচার্য ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যদের দেওয়া সম্মানী এবং এ খাতে রাজস্ব প্রদানসংক্রান্ত তথ্য ও প্রমাণপত্র পাওয়া যায়নি। আর যেসব নথি প্রদান করা হয় তা যথাযথ নয়। এসব সম্মানীর বিপরীতে সরকারকে যথাযথ কর প্রদান করা হয়নি। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য সাধারণ ভবিষ্যৎ তহবিল (জিপিএফ) গঠনের ক্ষেত্রে এনবিআরের অনুমোদন নেই। আবার ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর এসংক্রান্ত একটি আবেদন করা হয়েছে, কিন্তু তা বিশ্ববিদ্যালয় নয় রাগিব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন থেকে। তিন কোটি ৮৫ লাখ টাকা ২০ হাজার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন ছাড়াই দেওয়া হয়েছে। এ টাকা আবার পরে সমন্বয়ও করা হয়নি। একইভাবে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দুই কোটি ৮৪ লাখ টাকার একটি চেকনম্বরের বিপরীতে নগদ দেওয়া হয়, যা বেআইনি।এখানেই শেষ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়েরর জন্য জমি কেনা থেকে শুরু করে ভবনর নির্মাণ পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে পাঁচ কোটি ৩৬ লাখ ৮৫ হাজার ৩৪৫ টাকা উত্তোলন করা হয়। এর বিপরীতেও কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এই অভিযোগটিও প্রমাণিত হয়েছে। আবার আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ও বিওটির মনোনীত এক সদস্য মিলে সাধারণ তহবিল পরিচালনার বিধান থাকলেও তা লঙ্ঘন করে এসব অর্থ প্রদান করা হয়।২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত কোনো গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। ২০১৭-২০১৬ অর্থ বছরে ৮১ হাজার আর ২০১৮-২০১৯ বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয়ের তথ্য দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জনবলকে এখনো নগদে বেতন ভাতা দেওয়া হয়। এটা ব্যাংকের (ইএফটি) মাধ্যমে পরিশোধ করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তব্য-লিডিং ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড.এমআর কবির বলেন,আমি গত কয়েক মাস আগে এ পদে যোগ দিয়েছি। তাই এর আগের বিষয়গুলো যথাযথভাবে অবহিত নই। তবে যোগদানের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে আমাকে ইউজিসি অবহিত করেছে। বর্তমানে আর্থিক প্রশাসন সতর্কতার সঙ্গে আইন মেনে পরিচালনার চেষ্টা করছি। যদি না পারি তাহলে এ পদে আমি থাকব না। আর এনবিআরের খাতে বিভিন্ন ধরনের কর আদায় না করা কিংবা পূর্বানুমোদন না নেওয়ার ঘটনা সংশ্লিষ্টদের অনভিজ্ঞতার কারণে ঘটে থাকতে পারে। নিয়ম জানার পরে অবশ্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিওটির চেয়ারম্যান বা অন্য কোনো সদস্যের ব্যক্তিগত আয়কর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে পরিশোধের তথ্য আমার জানা নেই। এটুকু বলতে পারি,আমি আসার পরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি।সুত্র-যুগান্তর
Link copied!