বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিকাশের ‘প্রিয়’ অফারের আড়ালে অপ্রিয় ধান্দা

প্রকাশিত: ১১:৩৭ এএম, অক্টোবর ১৯, ২০২১

বিকাশের ‘প্রিয়’ অফারের আড়ালে অপ্রিয় ধান্দা

দেশে মোবাইল ব্যাংকি নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগের অন্ত নেই। নতুন নতুন অফারের ফাঁদে ফেলে কৌশলে গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। যথাযথ নজরদারি না থাকায় ও একক আধিপত্যের কারণে এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে বর্তমানে ২২টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বিকাশ। এরপরে নগদ ও রকেট। সম্প্রতি বিকাশের নতুন ‘প্রিয়’ এক অফারকে ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে গ্রাহকদের মধ্যে। বিকাশের এই প্রিয় অফারকে অপ্রিয় হিসেবে দেখছেন অনেকেই। মোবাইল ব্যাংকিং : মোবাইল ব্যাংকিং হলো ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত মোবাইল টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর পরিষেবা পদ্ধতি। মোবাইল ফোন ব্যবহার এই পদ্ধতির সাহায্যে দূর থেকে অর্থ লেনদেন করা হয়। অনলাইনে কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেবা দেওয়া হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। যেমন- ঘরে বসে টাকা আদান-প্রদান, পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, বিভিন্ন বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জসহ নানা রকম সুবিধা দিয়ে থাকে মোবাইল ব্যাংকিং। আর মোবাইল অ্যাপ এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে ব্যাংকিংয়ের সার্ভিসগুলো পাওয়ার সুযোগ থাকে। বর্তমানে বিকাশ বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মোবাইল ফোনভিত্তিক টাকা স্থানান্তর বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। ২০১১ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি প্রতিষ্ঠানটিকে। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় একক রাজত্ব করছে বিকাশ। জনপ্রিয়তার সঙ্গে অভিযোগও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ অতিরিক্ত চার্জ আদায়। সম্প্রতি তাদের ক্যাশআউট খরচ কমানোর বিষয়ে প্রচার চালাচ্ছে বিকাশ। আসলেই কি বিকাশের ক্যাশ আউট খরচ কমেছে? লাখ লাখ এজেন্টের মধ্যে একজন এজেন্ট বেছে নিয়ে গ্রাহক কতটুকু সুবিধা পাবেন? এটি আসলেই কি গ্রাহকসেবা নাকি আরও মুনাফা করার অপকৌশল? প্রশ্ন গ্রাহকদের। ক্যাশ আউট : বিজ্ঞাপনগুলোতে দেখা গেছে, একজন গ্রাহক একটি প্রিয় এজেন্ট নম্বরে ক্যাশ আউট করলে হাজারে ১৪ টাকা ৯০ পয়সা খরচ হবে। তবে এই একটি প্রিয় এজেন্টকে পুরো এক মাসের জন্য নির্বাচন করতে হবে গ্রাহকদের। চাইলেই কেউ এক মাসের আগে এই প্রিয় এজেন্টকে পরিবর্তন বা অন্য কোনো এজেন্টকে প্রিয় এজেন্টের তালিকায় যুক্ত করতে পারবেন না। গ্রাহকেরা তাদের প্রিয় এজেন্ট থেকে ১৪ টাকা ৯০ পয়সা রেটে মাসে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্যাশ আউট করতে পারবেন। কিন্তু গ্রাহক তার নির্ধারিত এজেন্ট ছাড়া অন্য কোনো এজেন্ট থেকে ক্যাশ আউট করলে খরচ পড়বে হাজারে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা। পাশাপাশি প্রিয় এজেন্টে ক্যাশ আউটের পরিমাণ যদি ২৫ হাজার অতিক্রম করে, সে ক্ষেত্রেও গ্রাহকদের গুণতে হবে প্রতি হাজারে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা, যা পূর্বে ছিল ১৭ টাকা ৫০ পয়সা। যেমন- কোনো এক মাসে একজন গ্রাহক ইতোমধ্যে ২৪ হাজার ৫০০ টাকা ক্যাশ আউট লেনদেন করেছেন। এখন তিনি যদি প্রিয় এজেন্ট নম্বর থেকে ৬০০ টাকা ক্যাশ আউট করতে চান (মোট ২৫ হাজার ১০০ টাকা) তা হলে এই লেনদেনের জন্য ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ চার্জ প্রযোজ্য হবে এবং প্রিয় এজেন্ট নম্বরে ক্যাশ আউট লিমিট শেষ হয়ে যাবে। একজন গ্রাহকের যেকোনো মুহূর্তে সর্বোচ্চ একটি প্রিয় নম্বর থাকতে পারবে। সেন্ড মানি : বিকাশ তার অ্যাপসে প্রিয় নম্বরের সেন্ড মানির বিস্তারিত তুলে ধরেছে। সেখানে বলা হয়েছে, সেন্ড মানির ক্ষেত্রে একজন গ্রাহকের একই সময়ে সর্বোচ্চ ৫টি নম্বর প্রিয় নম্বর হিসেবে থাকতে পারবে। যদি ইতোমধ্যে তার ৫টি প্রিয় নম্বর থাকে তা হলে নতুন আর একটি যোগ করার পূর্বে পুরনো একটি বাদ দিতে হবে। তবে এক মাসে সর্বোচ্চ ৫টি প্রিয় নম্বর যোগ করা যাবে। নিজের নম্বর এবং কোনো এজেন্ট বা মার্চেন্ট নম্বর প্রিয় নম্বর হিসেবে যোগ করা যাবে না। প্রিয় নম্বরে প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সেন্ড মানি করতে কোনো চার্জ প্রযোজ্য হবে না। তবে ২৫ হাজার ১ থেকে ৫০ হাজার টাকার ক্ষেত্রে ৫ টাকা চার্জ দিতে হবে এবং ৫০ হাজারের ওপরে গেলে ১০ টাকা চার্জ দিতে হবে। তবে যেকোনো নম্বরে ১০০ টাকা পর্যন্ত সেন্ড মানি করতে কোনো চার্জ প্রযোজ্য হবে না। গ্রাহকদের অভিযোগ, বিকাশ ৩ লাখ এজেন্ট থেকে একটি মাত্র এজেন্ট নির্বাচন করতে বলায় তাদের (গ্রাহক) ক্যাশ আউটে খরচ বেড়ে গেছে। কারণ আগে অ্যাপের মাধ্যমে দেশের সব এজেন্ট থেকে ক্যাশ আউট করলে খরচ হতো হাজারে ১৭ টাকা ৫০ পয়সা, আর এখন তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ টাকা ৫০ পয়সায়। এ ছাড়া সব জায়গায় গ্রাহকদের প্রিয় এজেন্ট না থাকায় তারা চাইলেই যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গা থেকে কম খরচে ক্যাশ আউট করতে পারছেন না, যা তাদের আর্থিক সেবা প্রাপ্তির স্বাধীনতাতেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। বেসরকারি চাকরিজীবী মো. মিলন মাহমুদ বলেন, বিকাশের এই প্রিয় এজেন্ট বা ১৪ টাকা ৯০ পয়সার সুবিধা নিতে হলে হয় আমাকে সবসময় নির্দিষ্ট একটি জায়গায় অবস্থান করতে হবে, না হয় হাজারে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা রেটে ক্যাশ আউট করতে হবে। এটা বাজারে অবস্থানরত অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং সেবার তুলনায় বৈষম্য ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রতিষ্ঠানটির এরূপ বেঁধে দেওয়া নিয়মের ফলে ক্যাশ আউটে আমাদের মতো গ্রাহকদের সে অর্থে তেমন কোনো উপকার হয়নি। কারণ আমি যেখানে খুশি, যত নম্বরে খুশি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করব এটা আমার স্বাধীনতা। কিন্তু অফার নিতে বিকাশ আমাকে নির্ধারিত একটি জায়গায় থাকতে বাধ্য করছে। এ ছাড়া ক্যাশ আউটের জন্য একটি এজেন্ট নম্বর ও সেন্ড মানির জন্য ৫টি প্রিয় নম্বরের মধ্যে আমার লেনদেন আটকে রাখছে। এটি কোনো গ্রাহকসেবা হতে পারে না। এটি তাদের ব্যবসার নতুন অপকৌশল। রিয়াজ রনি নামে আরেক গ্রাহক অভিযোগ করে বলেন, বিকাশের এই ক্যাশ আউটের তারতম্য গ্রাহকসেবায় একটি বৈষম্য তৈরি করেছে। সেবা খাতে সবার জন্য সমান সুবিধার বিষয়টি এখানে পুরোপুরি ব্যাহত হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অন্যান্য সেবাগুলো যেখানে গ্রাহকদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিচ্ছে, বিকাশ সেখানে গ্রাহকদের একটি নির্দিষ্ট এজেন্টের কাছে জিম্মি করে রাখার চেষ্টা করছে। ফলে ওই এজেন্টেরও মুনাফা বৃদ্ধিতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ মোবাইল ফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো মোবিলিটি। একজন গ্রাহক যখন, যেখানে খুশি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করতে পারেন। কিন্তু বিকাশ একজন গ্রাহককে নির্ধারিত একটি জায়গায় থাকতে বাধ্য করছে। এটি কীভাবে আর্থিক স্বাধীনতা হয়? এই অফারের ফাঁকে বিকাশ আরও একটি কাজ করেছে। সেটি হলো স্বাভাবিক লেনদেন খরচ বাড়িয়ে দেওয়া। বিকাশের অ্যাপে ক্যাশ আউট খরচ ছিল ১৭ টাকা ৫০ পয়সা। এখন এই অফারের ঘোষণা দিয়ে বিকাশ অ্যাপে ক্যাশ আউট চার্জ হাজারে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা নিচ্ছে। সারা দেশের প্রান্তিক মানুষ থেকে শুরু করে সবার খরচ এক টাকা করে বাড়িয়ে দিয়ে আবার গ্রাহকদের চটকদার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে বিকাশ। তিনি বলেন, এক দশক আগে ব্যবসা শুরু করার পর থেকে বিকাশ গ্রাহকদের সেবা দেওয়ার বিপরীতে উচ্চমূল্য নিচ্ছে। ক্যাশ আউট, সেন্ড মানি, বিল পে থেকে শুরু করে সব সেবায় গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত চার্জ, যা বাড়তি চাপে ফেলছে সাধারণ গ্রাহকদের। তাদের ওপর এই চাপ তৈরির অন্যতম কারণ মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় বিকাশের একক আধিপত্য। বাংলাদেশে বর্তমানে ২২টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এগুলো হলো- ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ, ডাক বিভাগের নগদ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের রকেট, রূপালী ব্যাংকের শিওর ক্যাশ, জনতা ব্যাংকের রেডি-ক্যাশ, ট্রাস্ট ব্যাংকের টি-ক্যাশ, ইউসিবি ব্যাংকের ইউ ক্যাশ, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মাই ক্যাশ, ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ব্যাংকিং, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের পল্লী লেনদেন, সাউথইস্ট ব্যাংকের টেলি-ক্যাশ, প্রিমিয়ার ব্যাংকের পি-মানি, ইসলামী ব্যাংকের এম ক্যাশ, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ইসলামিক ওয়ালেট, মেঘনা ব্যাংকের টপ অ্যান্ড পে, এবি ব্যাংকের আই ব্যাংকিং, ওয়ান ব্যাংকের ওকে অয়াললেট, সিটি ব্যাংকের সিটি টাচ, যমুনা ব্যাংকের জাস্ট পে, ইস্টার্ন ব্যাংকের স্কাই ব্যাংকিং, ঢাকা ব্যাংকের ডিবিএল গো এবং আইএফআইসি ব্যাংকের আমার অ্যাকাউন্ট। মাঠে ২২টি প্রতিষ্ঠান থাকলেও নেই কোনো প্রতিযোগিতা ও কর্তৃপক্ষের মনিটরিং। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, বিকাশের এই বিজ্ঞাপনটি আমি টেলিভিশনে দেখেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম অফারটি সবার জন্য। পরে দেখলাম এটি একটি প্যাকেজ অফার, সবার জন্য নয়। যদি কৌশলে কোনো গ্রাহককে কোনো নিয়ম মানতে বাধ্য করা হয় সেটি অপরাধ। যদি কোনো গ্রাহক অভিযোগ করে তা হলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব, আর যদি কেউ অভিযোগ নাও করে তা হলেও ব্যবস্থা নেব। আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করছি। বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, ডিজিটাল পেমেন্ট বেড়ে যাওয়ায় ক্যাশ আউটের পরিমাণ কমে গেছে। কাস্টমারের বিহেভিয়ার প্যাটার্ন দেখে এই অফারটি দেওয়া হয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৯৬ শতাংশ কাস্টমার ২০ হাজার টাকার নিচে ক্যাশ আউট করেন এবং তারা একজন এজেন্টের কাছ থেকেই করেন। ক্যাশ আউট তো কেউ দশ জায়গা থেকে করে না, যেখানে থাকে সেখান থেকেই করে। বেশিরভাগ মানুষ এই অফারে ক্যাশ আউট করছে এবং উপকার পাচ্ছে। যারা সব জায়গায় যান তারা শুধু বিকাশ ব্যবহার করেন না, কেউ কার্ড ব্যবহার করেন, অনলাইন ব্যাংকিং করেন।
Link copied!