বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিটিআরসিতে শতাধিক অবৈধ নিয়োগ-পদোন্নতি

প্রকাশিত: ০৯:৪২ পিএম, আগস্ট ২৯, ২০২১

বিটিআরসিতে শতাধিক অবৈধ নিয়োগ-পদোন্নতি

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) ১০ বছরে অন্তত ১০৫ জনের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে ব্যাপক অনিয়ম হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটি। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিএজি) এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পাঁচ মাসের তদন্তে এ প্রমাণ পেয়েছে মন্ত্রণালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের দুই সদস্যের এই কমিটি। কমিটি গত ১১ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনটি পাওয়ার কথা স্বীকার করে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে যে যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার তার সবই নেয়া হবে। মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অন্তত ১০৫ জনের নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি বিধির পাশাপাশি বিটিআরসির বিধিও মানা হয়নি। এই ১০৫ জনের বাইরে আরও অনেকের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অস্বচ্ছতা রয়েছে। বিটিআরসিতে ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত এই নিরীক্ষা করে সিএজি। রিপোর্টে ৫৯টি নিরীক্ষাসংক্রান্ত আপত্তি তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে ১৩টি অনুচ্ছেদ নিয়োগ ও পদোন্নতি-সম্পর্কিত। পরে এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে তদন্তে নামে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের যুগ্ম সচিবের (কোম্পানি) দপ্তর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৭ মার্চ ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের যুগ্ম সচিব মুহাম্মাদ আব্দুল হান্নানকে আহ্বায়ক করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। নিয়োগবিধি উপেক্ষা করে ২৯ জন জুনিয়র পরামর্শক নিয়োগ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশনের অভ্যন্তরীণ প্রার্থীদের মধ্য থেকে বিভিন্ন পদে ২৯ জনকে নিয়োগের জন্য ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল সকাল ১০টায় সাক্ষাৎকার ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। পরে ২৯ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হওয়ায় নিয়োগ কমিটির সুপারিশে কমিশনের ৯১তম সভায় অনুমোদনের মাধ্যমে বিটিআরসির বিভিন্ন রাজস্ব পদে ভূতাপেক্ষভাবে তারা নিয়োগ পান। অথচ এই ২৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৫ জনই (৫২ শতাংশ) নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে আবেদন করার ও নিয়োগ পাওয়ার অযোগ্য। প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে কতজন প্রার্থী আবেদন করেন, সেসব আবেদনের ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, বাছাই কমিটির প্রতিবেদনে তার কোনো উল্লেখ নেই। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চাকরি প্রবিধানমালা ২০০৯-এর প্রবিধান ৩(৬) অনুসারে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সব পদ উন্মুক্ত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূরণ করার নির্দেশনা থাকলেও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা না হওয়ায় প্রবিধানমালা ২০০৯ লঙ্ঘিত হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে আবেদনকৃত বৈধ প্রার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দেয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ নং অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রকল্পের ২১ কর্মচারীকে রাজস্ব খাতে নিয়োগ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে ‘স্ট্রেংদেনিং দ্য রেগুলেটরি ক্যাপাসিটি অফ বিটিআরসি’ প্রকল্পে নিয়োজিত প্রার্থীদের আবেদনসহ অগ্রাধিকার দিয়ে বিভিন্ন পদে ২১ জনকে সাক্ষাৎকার/মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয়। পরে ২০০৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের জন্য সাক্ষাৎকার হয়। এই মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় ২১ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে কতজন প্রার্থী আবেদন করেছেন, সেসব আবেদনের ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, বাছাই কমিটির প্রতিবেদনে তার উল্লেখ নেই। শুধু ‘স্ট্রেংদেনিং দ্য রেগুলেটরি ক্যাপাসিটি অফ বিটিআরসি’ প্রকল্পে নিয়োজিত ২১ জনের আবেদন বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এরপর সাক্ষাৎকার/মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। অথচ এই প্রকল্পের ২১ জন প্রার্থী বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে বিবেচনার যোগ্য নন। কারণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য এই পদগুলোর অনুমোদন হয়। মেয়াদ শেষে প্রকল্পের পদ রাজস্ব পদে স্থানান্তর না হওয়ায় কর্মরতদের বিটিআরসির বিভাগীয় প্রার্থী বিবেচনার সুযোগ নেই। পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে আবেদনকৃত বৈধ প্রার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দেয়া সংবিধানের ২৯ নং অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। চাকরিবিধি অমান্য করে নিয়োগ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিটিআরসির কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা ২০০৯ উপেক্ষা করে দুজনকে সিনিয়র সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। চাকরি বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও তিনজনকে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলেও মনে করে তদন্ত কমিটি। ২০১৮ ও ২০১৯ সালের নিয়োগেও অস্বচ্ছতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিটিআরটিসি ২০১৮ ও ২০১৯ সালের জনবল নিয়োগসংক্রান্ত সব কাজগপত্র তদন্ত কমিটিকে দিতে ব্যর্থ হওয়ায় নিয়োগ-প্রক্রিয়াটির অস্বচ্ছতা বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিটিআরসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগের মাধ্যমে পরীক্ষা নেয়ার কথা বলেছে। নম্বরপত্রে বিভাগের চেয়ারম্যানের সই থাকলেও কোনো তারিখ নেই এবং কোথা থেকে কার মাধ্যমে নম্বরপত্রটি এসেছে, তারও উল্লেখ নেই। এ ছাড়া লিখিত পরীক্ষার পর অন্য কোনো পরীক্ষা নেয়া হয়েছে কি না, নেয়া হলে কারা, কবে নিয়েছেন, চূড়ান্ত ফলাফলইবা কী- এ সম্পর্কে কোনো নথিপত্র তদন্ত কমিটিকে দেয়নি বিটিআরসি। তাই এই দুই বছরের নিয়োগে অস্বচ্ছতা রয়েছে বলে মনে করছে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তিগত সহকারীকে ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এলএলবি ৩য় বিভাগধারী হলেও এক মাসের মাথায় তাকে সহকারী পরিচালক পদে চলতি দায়িত্ব দিয়ে লিগ্যাল ও লাইসেন্সিং বিভাগে পদায়ন করা হয়। পরে ২০১৫ সালের অক্টোবরে তাকে সহকারী পরিচালক (সাধারণ) পদে পদোন্নতি দিয়ে লিগ্যাল ও লাইসেন্সিং বিভাগে পদায়ন করা হয়। স্নাতক (এলএলবি) ৩য় বিভাগধারী হওয়ায় তাকে সহকারী পরিচালক পদে চলতি দায়িত্ব ও পদোন্নতি দেয়া বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তার এলএলবি ৩য় বিভাগ কোনো ভূমিকা রাখে না। এ ছাড়া বিটিআরসিতে কর্মরত আরও তিনজনকে বিধিবহির্ভূতভাবে উপপরিচালক থেকে পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। একজনের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়ম তদন্ত কমিটি বলছে, একজনের সহকারী পরিচালক (সাধারণ) পদে নিয়োগ বিধিবহির্ভূত হওয়ায় তার চাকরি স্থায়ীকরণ ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক পদে পদোন্নতিও বিধিবহির্ভূত বলে যে আপত্তি তুলেছিল সিএজি, তার সত্যতা মিলেছে। অডিট প্রতিবেদনে বিটিআরসিতে সরকারি বিধিবিধান উপেক্ষা করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা প্রণয়ন করার কথা বলা হয়। আরও বলা হয়, জ্যেষ্ঠতার তালিকা প্রণয়নে এই অনিয়ম পদোন্নতি প্রদানে অনিয়মের ঝুঁকি তৈরি করেছে। এ ছাড়া কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা ২০০৯ (সংশোধিত)-এর অসংগতির পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ ও আইন শাখার কর্মকর্তদের কারিগরি শাখায় অনিয়মিতভাবে পদোন্নতি নেয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল সিএজির রিপোর্টে। এসব বিষয় যথার্থ বলে মনে করছে তদন্তকারী দল। অডিট প্রতিবেদনে নিয়োগবিধি উপেক্ষা করে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত (সরকারি পেনশনভোগী) ১৭ জন কর্মচারীকে রাজস্ব খাতে ড্রাইভার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। এ বিষয়ে তদন্তকারী দল তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, গণকর্মচারী (অবসর) আইন ১৯৭৪-এর ধারা ৫-এ পুনর্নিয়োগসংক্রান্ত ধারা উক্ত আইনের ২(আই) ধারার আলোকে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য নয় বিধায় সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কোনো সদস্যকে নিয়োগ করায় গণকর্মচারী (অবসর) আইন, ১৯৭৪ লঙ্ঘিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হয়েছে বিটিআরসির চাকরি প্রবিধানমালা ২০০৯। এ ছাড়া বয়স প্রমার্জনের ক্ষেত্রে সরকারি বিধি লঙ্ঘন করে বিটিআরসির রাজস্ব খাতের বিভিন্ন পদে ৩০ জনকে নিয়োগ দেয়ার যে অভিযোগ অডিট প্রতিবেদনে এসেছে, তারও সত্যতা পেয়েছে তদন্তকারী দল। কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, সিএজির অডিট টিম ২০১৬-২০১৭ থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বিটিআরসিতে আইন-বিধি-প্রবিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ ও পদোন্নতি সম্পর্কে যে প্রতিবেদন দিয়েছে তা সত্য। এসব নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়মসংক্রান্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘রিপোর্টটা আমাদের হাতে এসেছে। রিপোর্ট পর্যালোচনা করব। তারপর যে যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার, আমরা সেই সেই ব্যবস্থা নেব।’
Link copied!