শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিদেশে স্বোস্থ্যকর্মী রপ্তানি: বাংলাদেশও বাজারের অংশ পেতে চায়

প্রকাশিত: ১০:৩৬ এএম, জানুয়ারি ৯, ২০২২

বিদেশে স্বোস্থ্যকর্মী রপ্তানি: বাংলাদেশও বাজারের অংশ পেতে চায়

ডেইলি খবর ডেস্ক: বিদেশে চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তেলসমৃদ্ধ কুয়েতে নার্স ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয় বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল)।বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, এই নার্স ও টেকনোলজিস্টদের মাসিক বেতন হবে প্রায় ১ লাখ টাকা। ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে আবাসন সুবিধা ও যাতায়াত খরচও নিয়োগদাতারাই বহন করবে। করোনা রোগীর চাপ সামলানোর জন্য সংগ্রাামরত কর্মচারী সংকটে থাকা সরকারি হাসপাতালের বর্তমান চিত্র এবং সদ্যবিদায়ী ২০২১ সালে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের প্রায় আধডজন প্রতিবাদ কোনোটারই প্রতিফলন নেই বোয়েসেলের বিজ্ঞপ্তিতে।অদক্ষ জনশক্তি সরবরাহকারী দেশ থেকে স্বাস্থ্যকর্মী সরবরাহকারীতে পরিণত হওয়ার পথে অন্তত ছয়টি দেশে স্বাস্থ্যকর্মী সরবরাহের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ। এই ছয়টি দেশ হলো কুয়েত, মালদ্বীপ, সংযুক্ত আরব আমিরাত,কাতার, জার্মানি ও জাপান। কর্তৃপক্ষ বলছে,এই দেশগুলো ইতিমধ্যে বাংলাদেশ থেকে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যবিদ, সেবাদাতা, ডেন্টাল টেকনিশিয়ান আগ্রহ দেখিয়েছে। করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট দেখা দেওয়ায় এভাবে বেড়েছে চাহিদা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (নার্সিং ও মিডওয়াইফারি বিভাগ) হামিদুল হক বলেন,'জাপান এবং অন্যান্য দেশগুলো দক্ষ নার্স নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। আমরা এই আগ্রহ কাজে লাগানোর জন্য উন্মুখ।' বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস-এর তথ্যানুসারে,প্রথম ধাপে কুয়েত তাদের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের জন্য ৬ ক্যাটাগরিতে ৭৩৫ জন নার্স ও টেকনিশিয়ান নেবে।এছাড়াও সম্প্রতি মালদ্বীপও ডাক্তার ও নার্স নিয়োগের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে।এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মী রপ্তানির জন্য আরও দুটি সম্ভাব্য বাজারের কথা বলছে কর্তৃপক্ষ যুক্তরাজ্য ও গ্রিস। এসব নিয়োগের তত্বাবধানের জন্যে একসঙ্গে কাজ করছে জনশক্তি,কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর।হামিদুল হক জানান, কিছু বাংলাদেশি নার্স আগে থেকেই বিদেশে চাকরি করছেন। তবে তারা বিদেশে গেছেন নিজস্ব যোগ্যতা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে। এবারই প্রথম এ খাতে সরকারিভাবে জনবল পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।তবে বাংলাদেশ কতজন স্বাস্থ্যকর্মী বিদেশে পাঠাবে, কিংবা কবে পাঠাবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে পারেননি সরকারি কর্মকর্তারা। বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম জানান, দেশগুলো এখনও সুনির্দিষ্টভাবে তাদের চাহিদার পরিমাণ জানায়নি। এ ব্যাপারে আলোচনা চলছে। তিনি বলেন, 'এখন যেসব নার্সিং ইনস্টিটিউট আছে, সেখান থেকে ২০২২ সালে অনেক গ্র্যাজুয়েট বের হবে। তারা পাস করার সঙ্গে সঙ্গেই যাতে বিদেশ যেতে পারেন সেই লক্ষ্যে যৌথভাবে আমরা কাজ করছি। 'এমনকি যারা শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত থাকবেন, গ্র্যাজুয়েশনের আগেই তারা যাতে বিএমইটিতে নিবন্ধিত হতে পারেন, সেজন্য যারা বিদেশ যেতে ইচ্ছুক তাদের আমরা চাকরিপ্রত্যাশী হিসেবে তালিকাভুক্ত করব।'বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের (বিএনএমসি) তথ্যানুযায়ী, দেশে ২৭১টি বিএসসি ও ৫৪৭টি ডিপ্লোমা নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কলেজ (সরকারি ও বেসরকারি) রয়েছে। এসব কলেজে আসন আছে ৩৯ হাজারের বেশি। আর প্রতি বছর চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন প্রায় ১৫ হাজার নার্স।গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে নিবন্ধিত নার্স ও মিডওয়াইফের সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার ৭৩৯। তাদের মধ্যে প্রায় ৫৫ হাজার নার্স সরকারি হাসপাতালগুলোতে চাকরি করেন। বাকিরা বেশিরভাগই বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করছেন। কোভিড পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার গত বছর প্রায় ৬ হাজার নার্স নিয়োগ দেয়। তবে শহীদুল আলম বলেন, বৈদেশিক চাহিদা মেটানোর জন্য ২০২২ সালে কলেজগুলো থেকে যথেষ্ট পরিমাণ নার্স স্নাতক সম্পন্ন করে বের হবেন।এছাড়াও নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার সুরাইয়া বেগম বলেন,কলেজগুলোতেও আসনসংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতি বছর ৩০ হাজার নার্স স্নাতক সম্পন্ন করবেন।২০২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিøউএইচও) জানায়, বিশ্বে মোট নার্সের সংখ্যা ২.৭৯ কোটি এবং নার্সের ঘাটতি ৫৯ লাখ।বর্তমানে কর্মরত নার্সরাও প্রবীণ হচ্ছেন। আগামী দশ বছরে বিশ্বজুড়ে ১৭ শতাংশ নার্স অবসরে যাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানের সমপরিমাণ নার্স ধরে রাখার জন্যই কেবল নতুন ৪৭ লাখ নার্স লাগবে, ঘাটতি পূরণ তো আরও পরের ব্যাপার।২০৩০ সালের মধ্যে মোট এক কোটির বেশি নার্স প্রয়োজন হবে। একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি নার্স পাঠায় ফিলিপাইন ও ভারত। এই দেশগুলোতে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার ফিলিপিনো এবং ৯০ হাজার ভারতীয় নার্স কাজ করছে।মানের অগাধিকার-বিদেশি নিয়োগদাতাদের চাহিদার সঙ্গে বাংলাদেশি চিকিৎসক ও নার্সদের দক্ষতা সংগতিপূর্ণ কি না, তা স্পষ্ট নয়। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশের সম্ভাব্য এই জনবল যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও মান অর্জন করেছে, সেটি নিয়োগদাতাদের আগ্রহ থেকেই স্পষ্ট। তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্যের মতো বড় বাজারগুলোতে প্রবেশাধিকার লাভের জন্য আরও দক্ষতা অর্জনের বিকল্প নেই।প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড.আহমেদ মুনিরুস সালেহীন জানান, যুক্তরাজ্যে বিপুল সংখ্যক নার্স লাগবে। 'যদিও দেশটি বাংলাদেশ থেকে নিয়োগের প্রস্তাব দেয়নি,তবে আমরা বাজার ধরতে চাই। কিন্তু তার আগে বৈশ্বিক মানদন্ডে মানসম্মত কর্মী তৈরি করে আমাদেরকে প্রস্তুত হতে হবে,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি। টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি মো:জাকির হোসেন বলেন, বাংলাদেশ থেকে জাপানে দক্ষ কেয়ারগিভারদের পাঠানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।তিনি জানান, দ্বীপ দেশটি বিভিন্ন দেশ থেকে ৪৫ থেকে ৬০ হাজার দক্ষ কর্মী নিয়োগ করবে। দেশটি বাংলাদেশ থেকেও কর্মী নিয়োগ করবে।মালেস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি মো. সোহেল পারভেজ টিবিএসকে জানান, বর্তমানে মালদ্বীপে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ২০০ জন বাংলাদেশি চিকিৎসক কাজ করছেন। দেশটি ৩টি নতুন হাসপাতাল তৈরি করছে। সেখানে আরও স্বাস্থ্যকর্মী লাগবে। তিনি আরও বলেন, 'ঢাকা ও মালের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের আওতায় আমরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী আরও কর্মী পাঠাব, অবশ্যই বাংলাদেশের চেয়ে ভালো বেতনে।'প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'বিএমইটির অধীনে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে (টিটিসি) স্বাস্থ্যকর্মী কিংবা হেলথকেয়ার ওয়ার্কার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। তবে এই লক্ষ্যে ট্রেড কারিকুলামে আমূল পরিবর্তন আনা হবে।'বিএমইটির তথ্যানুযায়ী, গত বছর রপ্তানিকৃত বাংলাদেশি প্রমিকদের প্রায় ৭৪ শতাংশই অদক্ষ ছিল।আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য বলছে,একজন বাংলাদেশি প্রবাসীর পাঠানো গড় মাসিক রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২০৩ দশমিক ৩৩ মার্কিন ডলার (১৭ হাজার ২৩৬ টাকা)। অন্যদিকে একজন ফিলিপিনো প্রবাসী কর্মীর পাঠানো গড় মাসিক রেমিট্যান্স ৫৬৩ দশমিক ৭৪ ডলার, অর্থাৎ বাংলাদেশি প্রবাসীর প্রায় দ্বিগুণ। একজন পাকিস্তানি প্রবাসীর মাসিক গড় আয় ২৭৫ দশমিক ৭৪ ডলার, একজন ভারতীয় প্রবাসীর ৩৯৫ দশমিক ৭১ ডলার এবং চীনা প্রবাসীর গড় মাসিক আয় ৫৩২ দশমিক ৭১ ডলার।দেশের ঘাটতি সত্ত্বেও স্বাস্থ্যকর্মী রপ্তানিতে আত্মবিশ্বাসী কর্তৃপক্ষবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিøউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স নিয়োগ দিতে হয়েছে।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে,বাংলাদেশে নিবন্ধিত ডাক্তারের সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ৯৯৭ জন। এই সংখ্যক চিকিৎসকের বিপরীতে দেশে ৩ লাখের বেশি নার্সের প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিসের (বিএনএমসি) তথ্য অনুসারে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত নার্স ও মিডওয়াইফের সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার ৭৩৯ জন। অর্থাৎ দেশে প্রয়োজনের মাত্র ২৭ শতাংশ নার্স রয়েছে।বিএনএমসির রেজিস্ট্রার সুরাইয়া বেগম বলেন,প্রতি বছরই আমাদের নতুন গ্র্যাজুয়েট বের হয়। তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক নার্স বিদেশে গেলে তাতে আমাদের নিজস্ব চাহিদায় কোনো প্রভাব পড়বে না। সরকার প্রতি বছর নার্স নিয়োগ না করে। তারা যদি বিদেশের হাসপাতালগুলোতে ভালো বেতন পায়, তাহলে সেখানে যাবে না কেন?'বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে একজন নার্স ১০ম গ্রেডের কর্মচারী হিসেবে চাকরিতে ঢোকেন। সে সময় তার বেতন হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। তবে তিন-চার বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নার্স ও টেকনিশিয়ানদের মাসে ৭৩ থেকে ৯০ হাজার টাকা বেতন দেয় কুয়েত। বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইসমত আরা বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে নার্সদের সুনির্দিষ্ট কোনো বেতন কাঠামো নেই। হাসপাতালভেদে তাদের বেতন ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। সুত্র-টিবিসি
Link copied!