শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিষাক্ত রাসায়নিকের হুমকিতে পরিবেশ জনজীবন

প্রকাশিত: ১২:৪১ পিএম, জুন ১০, ২০২২

বিষাক্ত রাসায়নিকের হুমকিতে পরিবেশ জনজীবন

সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোর বিভীষিকাময় ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার নীল রঙের প্লাস্টিকের ড্রাম। যেগুলোর গায়ে লেখা- ‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড’ (৬০ শতাংশ)। গত শনিবার রাতের বিকট বিস্ফোরণের পর কন্টেইনারে থাকা বিষাক্ত রাসায়নিক মিশে গেছে বাতাসে। আবার পানির সঙ্গে মিশে চলে গেছে বিভিন্ন খাল হয়ে বঙ্গোপসাগরে। বিস্ফোরণের পর থেকেই সীতাকুণ্ডের ওই এলাকায় ঝাঁজালো গন্ধ। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই চোখে ঝাপসা দেখছেন; কারও কারও চামড়া বিবর্ণ বা লাল হয়ে গেছে। শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, বমিসহ দেখা দিচ্ছে নিত্যনতুন নানা উপসর্গ। এরই মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুদিন ধরে মাইকিং করা হচ্ছে- বৃষ্টি হলে কেউ যাতে বৃষ্টিতে না ভেজেন বা এই পানিতে গোসল না করেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও পরিবেশবিদরা বলছেন, সীতাকুণ্ডের এই এলাকায় প্রকৃতি বা পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকিতে পড়তে পারে। সেটা স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এ অবস্থায় ভারী বৃষ্টিপাত হলে বায়ুদূষণ কমে পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হবে। তবে রাসায়নিক মিশ্রিত পানি খালগুলোতে গিয়ে দূষণ সৃষ্টি হতে পারে। সব মিলিয়ে জনস্বাস্থ্যের ওপর নিঃসন্দেহে বিরূপ প্রভাব পড়বে। তারা আরও বলছেন, সীতাকুণ্ডের বাতাসে কী পরিমাণ রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, সেটা পরিমাপ করে দেখতে পারে পরিবেশ অধিদফতর। ওই এলাকার বাতাসে পিপিএমের (পার্টস পার মিলিয়ন) মাত্রা বেশি হলে অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব পড়বে। মঙ্গলবার বিএম কন্টেইনার ডিপোতে সরেজমিন দেখা গেছে, ডিপোর প্রবেশপথে দক্ষিণ পাশে গভীর ও চওড়া একটি নালা। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড মিশ্রিত পানি যাতে খাল-বিলে গিয়ে দূষণ ঘটাতে না পারে সেজন্য নালার মাঝ বরাবর বালির বস্তা ফেলে বাঁধ নির্মাণ করেছে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা। ঘটনার পরদিন রোববার সকালে তৈরি করা ওই বাঁধ সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বাঁধের একদিকে বিষাক্ত সেই রাসায়নিক মিশ্রিত পানি টইটুম্বর করছিল। পানি থেকে আসছিল উৎকট ও ঝাঁজালো গন্ধ। নালার বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত সেনাসদস্যরা বলেছেন, তারা এখানে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমেই বাঁধ তৈরি করে বিষাক্ত কেমিক্যাল খালে বা সমুদ্রে প্রবেশ ঠেকিয়েছেন। ডিপোর দুই প্রান্তে দুটি নালা ছিল, দুটিকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ডিপোর বাইরে অবস্থান করা হাফিজসহ কয়েকজন বলেছেন, শনিবার রাতে যখন আগুন লাগে এবং পরপর বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে তখন যে পরিমাণ পানি ছেটানো হয়েছিল, সেগুলো এবং বিষাক্ত রাসায়নিক অধিকাংশই নালার মাধ্যমে খালে বা সাগরে চলে গেছে। তবে সেনাবাহিনী এসেই নালাগুলো বন্ধ করে দিয়ে দূষিত পানি খাল-বিলে যাওয়া রোধ করে। তারা আরও বলেছেন, পানির সঙ্গে মিশে যাওয়া ছাড়াও বিস্ফোরণে যে পরিমাণ বিষাক্ত রাসায়নিক বাতাসের সঙ্গে মিশেছে, সেটিও এখন আমাদের জন্য বড় হুমকি। এখানকার পরিবেশ নিয়ে আমরা খুবই দুশ্চিন্তায় রয়েছি। এখানে অবস্থানকালে স্থানীয়দের কেউ কেউ বলেছেন, তাদের অনেকেরই চোখ জ্বালা-পোড়া করছে। মুখমÐল ও হাতের চামড়া লাল হয়ে যাচ্ছে, সেটাও দেখালেন উপস্থিত অনেকে। আগের দিন সোমবার দুপুরে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা আলী আকবরের সঙ্গে। দুর্ঘটনার পর শনিবার রাত থেকেই তিনি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিরলস দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘চোখ খুব জ্বালা-পোড়া করছে। মাঝেমধ্যেই ঝাপসা দেখছি। মুখমণ্ডল জ্বলছে। শরীরে বেশ অস্বস্তি অনুভব করছি। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারি না। কেমিক্যালের ঝাঁজালো গন্ধ নাকে লেগে থাকছে।’ মঙ্গলবার কথা হয় স্থানীয় আরেক বাসিন্দা আরিফুল হক সাদিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ডিপো থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরের বাসিন্দারাও বাতাসে পোড়া গন্ধ পাচ্ছে। আমি নিজেও চোখে ঝাপসা দেখছি। খাবার খেতে সমস্যা হচ্ছে।’ সীতাকুণ্ডের স্থানীয় বাসিন্দাদের শারীরিক সমস্যা ও এমন উপসর্গ নিয়ে কথা হয় প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের পর যা হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ‘কেমিক্যাল বার্ন’। এটার মাধ্যমে বায়ু দূষিত হয়েছে। আবার কেমিক্যালের তরলগুলো পানির সঙ্গে মিশেছে। সব মিলিয়ে ওই এলাকায় ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তেই পারে। চোখের সমস্যা, চামড়ার ক্ষত বা ঘা হওয়া, নিশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে গিয়ে সেখানে সংক্রমণ সৃষ্টি করা, লিভার-কিডনিসহ নানা ধরনের জটিল সমস্যা হতে পারে। এটা এখনও হতে পারে আবার কিছুদিন পরও এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। রাসায়নিকের এই বিরূপ প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এই প্রভাব থেকে যাবে ওখানকার বাতাস, খাদ্য ও পানিতে। এ অবস্থায় স্থানীয়দের করণীয় বিষয়ে ডা. আবদুল্লাহ বলেন, শরীরে এই জাতীয় কোনো লক্ষণ বা সমস্যা দেখা দিলে কোনোভাবেই দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনায় রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আরও একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক বিস্ফোরণের প্রভাবে আশপাশের লোকজন আক্রান্ত হতে পারে কেমিক্যালজনিত নানা রোগব্যাধিতে। এসবের মধ্যে রয়েছে- অঙ্গহানি, শ্বাসকষ্ট, ঝিমুনি, বমি বমি ভাব, নাক ও গলার জ্বালা, চামড়ায় ফুসকুড়ি, ক্লান্তি, ত্রæটিপূর্ণ শিশুর জন্ম, গর্ভপাত, বন্ধ্যত্ব, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি, ক্যানসার, রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা, ফুসফুসের রোগ, জন্ডিস, চর্মরোগ, অ্যাজমা, নাসারন্ধ্রের ক্যানসার ইত্যাদি। সীতাকুণ্ডে পরিবেশের প্রভাব নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগুন বা বিস্ফোরণ এমনিতেই পরিবেশের ক্ষতি করে। এর মধ্যে সীতাকুণ্ডে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটেছে। বিস্ফোরণে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বাতাসে মিশে গিয়ে পরিবেশের বড় ধরনের ক্ষতি করেছে। তিনি আরও বলেন, যেকোনো বিস্ফোরণে সাধারণ তিন ধরনের ক্ষতি হয়। রাসায়নিক বাতাসের সঙ্গে মিশে বাতাস দূষিত করাসহ স্থায়ী বিরূপ প্রভাব তৈরি করে; দীর্ঘ সময়ের জন্য মাটিতে মিশে মাটির গুণাগুণ ও সক্ষমতা নষ্ট করে এবং নদ-নদীসহ আশপাশের জলাধারে মিশে বড় ধরনের ক্ষতি করে। সীতাকুণ্ডেও পরিবেশের এই তিন ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হুমায়ুন কবির বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিকের বিস্ফোরণ ঘটেছে। এগুলো স্থানীয় জনগণসহ আশপাশের পরিবেশের বড় ধরনের ক্ষতি করবে, যা স্থায়ীভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, উদ্ধারকাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও রাসায়নিকের অনেক উপাদান মাটিতে মিশে থাকবে। অনেক উপাদান পাশের সাগরে গিয়ে মিশে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করবে। এভাবে মানুষ, পরিবেশ ও প্রতিবেশের বড় ধরনের ক্ষতি করবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা কীভাবে এড়ানো যায়, সে প্রসঙ্গে এই গবেষক বলেন, রাসায়নিক এমনিতেই স্পর্শকাতর। এ কারণে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। রাসায়নিক উপাদান আছে, এমন কিছু ওই লোকালয়ে না রাখা উচিত। এ ছাড়া দুর্ঘটনার পেছনে যাদের অবহেলা রয়েছে তাদের শাস্তির আওতায় আনাসহ পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। সীতাকুণ্ড দুর্ঘটনার রাসায়নিক ক্ষতি ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আফতাব আলী শেখ। তিনি বলেন, রাসায়নিক দূষণ এক জায়গায় থেমে থাকে না। চোখে না দেখা গেলেও তা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা মানবদেহের ক্ষতি করে। সীতাকুণ্ডের দূষণ দুয়েকদিনের মধ্যে ঢাকায়ও পৌঁছবে।
Link copied!