শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বেফাঁস মন্তব্য করে বিপদে আ.লীগের যেসব নেতা

প্রকাশিত: ০৬:৪৯ পিএম, ডিসেম্বর ৭, ২০২১

বেফাঁস মন্তব্য করে বিপদে আ.লীগের যেসব নেতা

এক মাসও যায়নি। আওয়ামী লীগের দুজন বড় নেতা তাঁদের পদ হারালেন। প্রথমজন দেশের বৃহত্তম সিটি করপোরেশন গাজীপুরের মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলম। দ্বিতীয়জন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. মুরাদ হাসান। মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে প্রথমে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে তাঁকে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। আর মুরাদ হাসানকে আপাতত প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বলা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হবে বলে মঙ্গলবার জানিয়েছেন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিরোধী নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার, কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা দেশের রাজনীতির সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। অনেক সময় দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মাধ্যমেই কনিষ্ঠরা এসব কাজে উদ্দীপ্ত হন। সর্বশেষ মুরাদ হাসানের ঘটনা এরই একটি প্রতিফলন। তবে তাঁকে পদত্যাগের মাধ্যমে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেই তাঁদের ধারণা। সাত বছর আগে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এ বেফাঁস মন্তব্য করেই মন্ত্রিত্ব ও দলের পদ হারান। এক মাসের ব্যবধানে দুই তরুণ নেতার এসব লাগামহীন কথাবার্তা এবং এর ফলে পদ হারানোর ঘটনা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বিরক্ত হয়েছেন। তবে তাঁরা বলছেন, বেসামাল মন্তব্য করে পার যে পাওয়া যাবে না, সেই বার্তা দিয়ে দল তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। এ কঠোর অবস্থান মাঠপর্যায়ে শক্তিশালী বার্তা দেবে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘মুরাদ হাসানকে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। দলের ভাবমূর্তি নষ্টকারীদের প্রতি দল যে কঠোর, সেই বার্তা দেওয়া হলো এই কাজের মাধ্যমে।’ লতিফ সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর আলম, মুরাদ হাসান এবং রাজশাহীর কাঁটাখালীর মেয়র আব্বাস আলীর মন্তব্যের ধরন ও পরিসর ভিন্ন। কারও বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননা, কারও বিরুদ্ধে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে মন্তব্যের অভিযোগ। লতিফ সিদ্দিকী প্রকাশ্য সভায় কথা বলেছেন। আর তিনি যা বলেছেন, তা তিনি অস্বীকার করেননি। জাহাঙ্গীর আলম ও আব্বাস আলীর ব্যক্তিগত কথোপকথন ফাঁস হয়ে ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মুরাদ হাসান একটি ফেসবুক লাইভে এসেই অরুচিকর মন্তব্য করেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনা নিয়ে আলোচনার মধ্যেই অভিনেত্রী মাহিয়া মাহির সঙ্গে মুরাদ হাসানের কথাবার্তার একটি অডিও ফাঁস হয়। এ ছাড়া আরেকটি লাইভে এসে নারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মুরাদের অশালীন মন্তব্যও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। ২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে এক অনুষ্ঠানে হজ ও তাবলিগ জামায়াত নিয়ে কটূক্তি করায় লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রিত্ব যায়। একই সঙ্গে নিজ দল আওয়ামী লীগ থেকে তিনি বহিষ্কৃত হন। তাঁকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে লতিফ সিদ্দিকীকে দেওয়া কারণ দর্শানোর নোটিশে বলা হয়, ‘আপনার এ বক্তব্য কেবল গর্হিত ও অনভিপ্রেতই নয়, বাংলাদেশ ও মুসলিম উম্মাহর প্রতি আঘাতস্বরূপ। তা আওয়ামী লীগের নীতিবিরোধী এবং আদর্শ ও গঠনতন্ত্রের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’ মন্তব্যের জেরে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কয়েক ডজন মামলা হয়। জারি হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তাঁর গ্রেপ্তার ও বিচার চেয়ে হরতালও ডাকে কয়েকটি ইসলামি দল। লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। সেই পদ থেকে বাদ দেওয়ারে ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্রের ৪৬ ‘ক’ অনুচ্ছেদের কথা বলে দলটি। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো সদস্য আওয়ামী লীগের আদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলি বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপন্থী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করিলে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল, কার্যনির্বাহী সংসদ, সংসদীয় বোর্ড বা সংসদীয় পার্টির বিরুদ্ধে কোনো কাজ করিলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ তাহার বিরুদ্ধে যেকোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।’ লতিফ সিদ্দিকীকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হয় গঠনতন্ত্রের ৪৬ ‘ঞ’ অনুচ্ছেদ অনুসারে। সেখানে বলা আছে, ‘সংগঠনের যেকোনো শাখা তাহার যেকোনো কর্মকর্তা বা সদস্যকে দলের স্বার্থ, আদর্শ, শৃঙ্খলা তথা গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের জন্য স্ব স্ব পদ বা দায়িত্ব হইতে অব্যাহতি প্রদান করিতে পারিবে। তবে এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন শাখার অনুমোদন প্রয়োজন হইবে এবং এই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শাখার সাধারণ সভায় দুই–তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হইবে। ঊর্ধ্বতন শাখা পরবর্তী ১ মাসের মধ্যে তাহার সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট শাখাকে জানাইবে, অন্যথায় সিদ্ধান্তের সহিত একমত বলিয়া গণ্য হইবে।’ লতিফ সিদ্দিকী দলের একাধিকবারের সাংসদ। তাঁর ভাই কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। কাদের সিদ্দিকীও আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন ১৯৯৯ সালে। দুই ভাই দল থেকে যখন বহিষ্কৃত হন তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন দল হিসেবেই ছিল। সেই ক্ষমতাসীন দল গত ১৯ নভেম্বর বহিষ্কার করল গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে। সেদিন শুক্রবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বহিষ্কারের কথা জানান তিনি। গত সেপ্টেম্বর মাসে গোপনে ধারণ করা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন। এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান। এ ঘটনায় গাজীপুরের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ নিয়ে গাজীপুরে মেয়র-সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে কয়েক দফা। ৩ অক্টোবর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জাহাঙ্গীর আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। ১৮ অক্টোবরের মধ্যে জাহাঙ্গীরকে এর জবাব দিতে বলা হয়। তিনি জবাবও দেন। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ‘সুপার এডিট’ করা বলে বারবার দাবি করেন জাহাঙ্গীর আলম। এদিকে ওই ভিডিওর জের ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমের সম্পর্ক কার্যত ছিন্ন হয়ে যায়। গাজীপুরে সরকারি নানা কার্যক্রমে জাহাঙ্গীর আলমকে প্রকারান্তরে এড়িয়ে চলার ঘটনাও ঘটতে থাকে। তাঁর উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে অনড় থাকেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। জাহাঙ্গীর আলম স্কুল থেকে কলেজ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জেলার ছাত্রলীগ ও পরে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও স্থান পান। এরপর গাজীপুরের সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে গাজীপুর সিটির মেয়র হন তিনি ২০১৮ সালে। জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কারের পর ২৫ নভেম্বর মেয়র পদ হারান তিনি। এ বিষয়ে সেদিন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এর আগে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের কাছে জাহাঙ্গীর আলমের বরখাস্তের বিষয়টি জানান। এই বহিষ্কারের জের কাটতে না কাটতেই এল তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের অডিও। প্রথমে তিনি আলোচনায় আসেন রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কথা বলে। পরে খালেদা জিয়া এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেন ফেসবুকের এক সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে। তাঁর বক্তব্যে শুধু বিএনপি নয় আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা সমালোচনা করেন। নারীবাদীরা কঠোর সমালোচনা করেন। বিরোধী দলের প্রধান নেত্রীর পরিবারের সদস্যদের করা অশালীন কথা নিয়ে সমালোচনা যখন তুঙ্গে তখন অভিনেত্রী মাহিয়া মাহির সঙ্গে মুরাদ হাসানের কথোপকথনের একটি অডিও ফাঁস হয়। প্রকাশ অযোগ্য সেসব কথা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর জেরে গতকাল রোববার মুরাদকে তাঁর পদ ছাড়তে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রশ্ন উঠেছে, এক মাসের মধ্যে দলের দুই তরুণ নেতার এই পদস্খলন দলের ভাবমূর্তি কি ক্ষতিগ্রস্ত করবে না? আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। ব্যক্তিবিশেষের ভুল কাজের দায় দল কেন নেবে। যে কথা সমাজ, মানুষ বা দলের কাছে গ্রহণযোগ নয়, তা যদি কেউ বলে তবে এর দায় দল কেন নেবে। দল সেই ব্যক্তিকে যথোপুযুক্ত সাজা দিয়ে তার দায়িত্ব পালন করবে। এ ক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে। এ ধরনের দু–একজন তরুণ নেতা আওয়ামী লীগ থেকে চলে গেলে তাতে দলের কিছু এসে যায় না।’ মাহবুব উল আলম হানিফ মনে করেন, জাহাঙ্গীর আলম ও মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা মাঠে দলীয় নেতা-কর্মীকে দলীয় কঠোর অবস্থানের বার্তা পাঠাবে। আখেরে এতে লাভ বৈ ক্ষতি হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপত শান্তনু মজুমদার মনে করেন, মুরাদ হাসানকে পদ থেকে সরে যেতে বলার এই কঠোর সিদ্ধান্ত নেতাদের ‘বেসামাল আচরণ’ রোধে শক্তিশালী বার্তা দেবে। শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘এর ফলে অনেক নেতা নিজেদের সামাল দেওয়ার দিকে মনোযোগী হবেন। জাহাঙ্গীর আলমের পর মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে এ সিদ্ধান্ত একটি তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত।’ শুধু শাসক দল নয়, দেশের একাধিক বড় রাজনৈতিক দলের একাধিক নেতা তাঁদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নানা মন্তব্য করেন যেগুলো শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও যথেষ্ট। জ্যেষ্ঠ নেতাদের এসব কথা অনেক সময় কনিষ্ঠদের উদ্দীপ্ত করে বলে মনে করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ কে এম মাহমুদুল হক। তিনি বলেন, ‘প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অশালীন কথা বলা, অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। অনেক সময় এটা বলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বড়রা বললে ছোট নেতারা তাঁকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এসব প্রচেষ্টাকে পুরস্কৃত না করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াটা যুক্তিযুক্ত। মুরাদ হাসানের বেলায় তাই হয়েছে এবং তা যথার্থ হয়েছে। এটা রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হয়েছে। রাজনীতির জন্য ভালো হয়েছে।’ সূত্র: প্রথম আলো
Link copied!