শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বৈদেশিক সাহায্য কতটা নেব, কেন নেব!

প্রকাশিত: ০৭:১৮ পিএম, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২১

বৈদেশিক সাহায্য কতটা নেব, কেন নেব!

আবু তাহের খান বাংলাদেশে বৈদেশিক সহায়তার ধরন, বৈশিষ্ট্য ও ফলাফল নিয়ে এ পর্যন্ত বহুসংখ্যক গবেষণা পরিচালিত হলেও সেগুলোর সার-বক্তব্য প্রায় কখনোই সাধারণের মধ্যে খুব একটা প্রচার পায়নি। তবে গড়পড়তা মানুষের মধ্যে এসব সহায়তার প্রভাব ও কার্যকারিতা নিয়ে এক ধরনের মিশ্র অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বড়সংখ্যক মানুষই মনে করেন, বৈদেশিক সহায়তা পেলে তা নেওয়াই উচিত এবং তা যত বেশি নেওয়া যায় ততই ভালো। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের প্রচারণায় এমনটিই দাবি করার চেষ্টা করেন, যারা যত বেশি বৈদেশিক সাহায্য জোগাড় করতে পারেন, বিদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তত ভালো; এবং বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ কমে গেলে বিরোধী রাজনীতিকরা একে ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতা হিসাবেও তুলে ধরার প্রয়াস পান। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা প্রত্যাখ্যান করার পর প্রথমদিকে বিরোধী দলসহ অনেকেই একে ভুল সিদ্ধান্ত হিসাবে অভিহিত করার চেষ্টা করেন। অবশ্য এদের একটি বড় অংশই পরবর্তী সময়ে তাদের মত পরিবর্তন করেন। অন্যদিকে বৈদেশিক সাহায্যের নেপথ্যের নানা হিসাব-নিকাশ ও কার্যকারণ সম্পর্কে যারা টুকটাক খোঁজখবর রাখেন, তারা ভালোভাবেই জানেন, এসব সাহায্যের একটি বড় অংশই দাতারা প্রদান করেন তাদের নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থে এবং তা থেকে বাংলাদেশ খুব একটা লাভবান হয় না। বরং বহু ক্ষেত্রে এসব সাহায্য গলার কাঁটা বা ফাঁস হয়ে দেখা দেয়।অনেক ক্ষেত্রে তা উপকারের পরিবর্তে উল্টো ক্ষতির কারণ হওয়ার মতো ঘটনাও রয়েছে। আর ঋণভিত্তিক সাহায্য নিয়ে তা পরিশোধের দায় জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে প্রতিবছরের বাজেটে সাধারণের ওপর বাড়তি কর আরোপের যেসব ঘটনা ঘটে, সাধারণ মানুষকে তো তা বুঝতেই দেওয়া হয় না। এমনকি বহু বড় দাতাসংস্থার কর্মীরা তাদের চাকরি-বাকরি ও পরামর্শসেবা (কনসালটেন্সি) টিকিয়ে রাখার জন্যও এসব সাহায্য প্রদান করে থাকেন। ইউএনএইচসিআর-এর ব্যাপারে তো প্রকাশ্য অভিযোগই রয়েছে, তারা রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ সময় ধরে শরণার্থী হিসাবে পেতে এবং সে অনুযায়ী তাদের জন্য সাহায্য অব্যাহত রাখতে চায়। বাংলাদেশের বৃহত্তর স্বার্থের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে রেলপথ সংকুচিত করে ফেলার পরামর্শ এক সময় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বিশ্বব্যাংক মিলেই প্রদান করেছিল। দাতাদের এসব হীন সংশ্লিষ্টতার বিষয়গুলো এদেশে দীর্ঘকাল ধরে চলে এলেও নানা শ্রেণি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে এগুলো বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে এবং সহসা তা থামবে বলেও মনে হয় না।আর এরূপ পরিস্থিতিতে অনেকটা উদ্বেগের সঙ্গেই লক্ষ করা যাচ্ছে, করোনার এ দুঃসময়কে পুঁজি করে উল্লিখিত হীন ধারার বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প আবারও বাংলাদেশের মানুষের ঘাড়ে চেপে বসেছে এবং ধারণা করা হচ্ছে, শিগ্গির হয়তো আরও নতুন প্রকল্প এর সঙ্গে যুক্ত হবে। করোনাজনিত জররি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিস্তারিত যাচাই-বাছাই না করেই এমন কিছু বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প সম্প্রতি দেশে গ্রহণ করা হয়েছে, যেগুলোর গুণাগুণ ও ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে।এগুলোর কোনো কোনোটির বাস্তবায়ন পর্যায়ের নানা অনিয়ম, অসঙ্গতি ও অপ্রাসঙ্গিকতার তথ্য ইতোমধ্যে মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আর সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণান্তে দেখা যাচ্ছে যে, এসব কোভিড সহায়তা প্রকল্পের একটি বড় অংশজুড়েই রয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য যানবাহন ও অন্যান্য আয়েশি সামগ্রীক্রয়, পরামর্শসেবা এবং বিভিন্ন আঙ্গিকের পরিচালন ব্যয়, যেসবের সঙ্গে করোনা রোগীর চিকিৎসা, চিকিৎসা-উপকরণ সংগ্রহ বা চিকিৎসা-গবেষণার কোনো সম্পর্ক নেই।কিন্তু করোনার মতো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার বিষয়টি সামনে রেখে প্রকল্পগুলো যখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়, তখন তারাও হয়তো সেগুলো অতটা যাচাই-বাছাই করে দেখেননি। আর সেই সুযোগে প্রকল্প উপস্থাপনকারী কর্মকর্তাদের খায়েশ মতো এমন অনেক কিছুই সেখানে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়েছে, যা করোনা রোগীর কোনো উপকারে না এলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মনোবাসনা পূরণে যথেষ্টই সহায়ক হয়েছে। অন্যদিকে, বিভিন্ন দুর্যোগ-দুর্বিপাকে এ জাতীয় দাতারা সাধারণত দেখাতে চান, সমস্যাগ্রস্থ দেশকে সাহায্যদানে তারা দ্রæত এগিয়ে এসেছেন। সরকার বা জনগণও তা দেখে যথেষ্টই প্রীত হন। কিন্তু সে সাহায্যের কতটা কাজে আসে আর কতটা নানা পর্যায়ে ভাগাভাগি হয়ে যায়, তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ কখনোই জনগণের প্রতিবোধের সঙ্গে মিলল কিনা তা খতিয়ে দেখা হয় না। তবে পত্রপত্রিকায় এসব প্রকল্পের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার খবর প্রকাশিত হওয়ার পরই কেবল কিছুটা খোলাসা হয়, যেসব উদ্দেশ্য ও কাজের কথা বলে এসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, বাস্তবে সেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে তা কোনো কাজে আসছে না। এর পাশাপাশি অত্যন্ত মনোকষ্টের সঙ্গে লক্ষ করতে হয়, প্রায় কোনো উপকারেই না আসা এ প্রকল্পগুলোতে দাতাদের কাছ থেকে অর্থের জোগানটি গ্রহণ করা হয় ঋণ হিসাবে, অনুদান হিসাবে নয়। অর্থাৎ এ সহায়তা জনগণের কোনো কাজে না এলেও তাদের তা সুদ-আসলেই পরিশোধ করতে হবে। অবশ্য অর্থমন্ত্রী মহোদয় এ ধরনের মহাজনী ঋণ সংগ্রহের জন্যপ্রায়ই কৃতিত্ব দাবি করে থাকেন।সাম্প্রতিক সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যায়, বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকায় করোনা চিকিৎসার জন্য কেনা যন্ত্রপাতি,সরঞ্জাম ও অন্যান্য উপকরণাদি বিমানবন্দরে,হাসপাতালের গুদামে ও অন্য জায়গায় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থেকেছে। আর যেসব সামগ্রী ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলোর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে বিনা দরপত্রে কেনাকাটা, করোনা উপশমে কোনো কাজ না হলেও সর্বাগ্রে কর্মকর্তাদের জন্য যানবাহন ক্রয়, ৩৫৬ টাকা পিস দরে সার্জিক্যাল মাস্ক ক্রয়, বিশেষ সম্মানী ও ভাতা গ্রহণ ইত্যাদি। এবং দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী,বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট কোভিড চিকিৎসাসংক্রান্ত প্রকল্পগুলোতেই এ ধরনের দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি হয়েছে। আর দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই রয়েছেন সবচেয়ে বেশি সংখ্যায়, যাদের ওপর ভরসা করে রাজনীতিকদের সরিয়ে দিয়ে উন্নয়ন কর্মকান্ডের দায়িত্ব তাদের ওপরই ন্যস্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে প্রকাশিত এসব তথ্য থেকে এটিও প্রমাণিত হয়, উল্লিখিত এ প্রকল্পগুলো যথেষ্ট যাচাই-বাছাই ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই যেমন গ্রহণ করা হয়েছে, তেমনি বাস্তবায়ন পর্যায়ে দুর্নীতির সুযোগ ও অনিয়ম সাধনের জন্য সচেতনভাবে ফাঁকফোকর রেখেই প্রকল্পগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কোভিড সহসা কেটে যাবে, এমন লক্ষণ মোটেও চোখে পড়ছে না। আর ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা সংক্রান্ত ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন কবে নাগাদ সম্পন্ন হবে, সেটিও নীতিনির্ধারকরা এখন পর্যন্ত জানাননি। ফলে আগামী অন্তত ২-৩ বছর বাংলাদেশকে করোনার সঙ্গে বসবাস করেই কাটাতে হবে বলে মনে হয়। আর এ সময়ের মধ্যে দাতারা নিশ্চয় আরও বেশ কিছুসংখ্যক করোনা সহায়তা প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে আসবেন বলে ধারণা করা চলে। সেক্ষেত্রে দাতা সংস্থাগুলোকে পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই ও উপযুক্ত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়া কোনো প্রকল্প গ্রহণে সহজ-সম্মতি প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করব। কারণ শেষ পর্যন্ত এ অর্থ বাংলাদেশের জনগণকেই পরিশোধ করতে হবে,যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ঋণ। অন্যদিকে পরিকল্পনা কমিশনকে অনুরোধ করব, করোনা নিরাময় জরুরি বলেই গোঁজামিল দিয়ে যেনতেন উপায়ে দুর্নীতির সুযোগ রেখে প্রণীত এসব প্রকল্প হাতে পাওয়া মাত্রই যেন অনুমোদন দিয়ে দেওয়া না হয়।আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা সিএমএসডিকে এ বিষয়ে কিছু না বলাই ভালো। কারণ অনুসৃত পথ থেকে তারা সহসা সরে আসবেন এমনটি সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে না। গোপালভাড় যেমন আলুর গুদামে আবার কবে আগুন লাগবে জানতে চেয়েছিলেন, এরাও তেমনি বুঝতে চায় করোনা আর কতদিন প্রলম্বিত হবে। আর নীতিনির্ধারক মাননীয় রাজনীতিকদের বিনয়ের সঙ্গে বলি, জাতীয় সংসদে কত ছোটখাটো বিষয় নিয়েই তো কথা হয়। অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ না নেওয়া নিয়েও কথা হয়েছে, যা জনগণও সমর্থন করেছে। কিন্তু কোভিডে বিশ্বব্যাংক,এডিবি ও অন্য কোনো কোনো দাতার এসব অকার্যকর অর্থ সাহায্য বাংলাদেশ গ্রহণ করবে কিনা, বিশেষত যখন সেটি ঋণ, তা নিয়ে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে জনগণকে জানালে কেমন হয়! কারণ জনগণের নামে আনা এসব ঋণ শেষ পর্যন্ত জনগণকেই তো পরিশোধ করতে হবে। আমরা করোনা থেকে যেমন মুক্তি চাই, তেমনি বৈদেশিক সাহায্যের অপ্রয়োজনীয় ফাঁদ থেকেও রেহাই পেতে চাই। আর সাহায্য নিতে হলে ততটুকুই চাই, যতটুকু আমাদের কাজে আসবে এবং অবশ্যই তা জনগণকে জানিয়ে নিতে চাই। কারণ প্রকারান্তরে এ বোঝা তো তাদেরই বইতে হবে।সুত্র-যুগান্তর আবু তাহের খান:পরিচালক,ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার,স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ;সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয় ।  
Link copied!