শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ব্যক্তির গোপনীয়তা চরম হুমকিতে

প্রকাশিত: ০৮:৫৮ এএম, মে ২৭, ২০২১

ব্যক্তির গোপনীয়তা চরম হুমকিতে

টেলিফোনে আড়ি পাতা, টেলিফোনের কথোপকথন রেকর্ড করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া দেশে নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি পুলিশের দুজন কর্মকর্তার ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার বিষয়টি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে। গত ১৭ মে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের মামলায় একজন নারী সাংবাদিক গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওই সাংবাদিকের এক নারী সহকর্মী তাঁর বাবার সঙ্গে টেলিফোনে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। এ কথোপকথনও ফাঁস হয় এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। গত এপ্রিলে নিজ স্ত্রীর সঙ্গে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের ফোনালাপের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। বিতর্কিত ব্যক্তিদের সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এর শিকার। সাধারণ নিরপরাধ মানুষও নিরাপদ নয়। দেশের টেলিযোগাযোগ আইনে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড এবং পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু এ অপরাধে কারো শাস্তি পাওয়ার ঘটনা বিরল। শুধু ফোনালাপ নয়, টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেকের একান্ত ব্যক্তিগত অডিও-ভিডিওসহ নানা তথ্য প্রকাশের ঘটনা বাড়ছে। সম্প্রতি দেশের উচ্চ আদালতের এক রায়ে বলা হয়েছে, ‘আমরা ইদানীং লক্ষ করছি যে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল অডিও-ভিডিও কথোপকথন সংগ্রহ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করছে। ওই কথোপকথনের অডিও-ভিডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস করার অভ্যাস বন্ধ হওয়া উচিত।’ আদালত এ-ও বলেছেন, ‘আমরা এটা ভুলে যেতে পারি না যে সংবিধানের ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তাই এটা রক্ষা করা ফোন কম্পানি ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) দায়িত্ব। তাই এটা বন্ধে বিটিআরসিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।’ নেত্রকোনার শিশু সৈকত হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত দুই আসামির আবেদনের ওপর হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ কথা বলেছেন আদালত। বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এ এস এম আব্দুল মোবিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চের পূর্ণাঙ্গ এই রায় গত বছর ২৬ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। রায়ে আরো বলা হয়েছে, কোনো গ্রাহকের ফোন কল লিস্ট ও কথোপকথনের রেকর্ড নিতে হলে আইন অনুযায়ী মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন করতে হবে, কিন্তু কোনো শিকারির মতো তা সংগ্রহ করা যাবে না। আইনগত অনুমতি ছাড়া ফোন কম্পানি ফোন গ্রাহককে অবহিত না করে গ্রাহকদের যোগাযোগ সম্পর্কিত কোনো তথ্য কাউকে সরবরাহ করতে পারে না। দেশে ফোন কলে আড়ি পাতা এবং তা প্রকাশ ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত সবার জন্যই নিষিদ্ধ ছিল। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধন করে এর ৯৭ক ধারায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার জন্য এর বৈধতা দেওয়া হয়। আইন অনুসারে এসব কাজের জন্য সংস্থাগুলোক কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অথবা প্রতিমন্ত্রীর অনুমতি নিতে হবে। এ আইনে কাদের ফোনে আড়ি পাতা যাবে, কত দিন যাবে, তা বলা নেই। আইন সংশোধনের ফলে অপরাধমূলক নানা ঘটনা তদন্তে সহায়ক হলেও সে সময় বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয় এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো এভাবে আইন সংশোধনের প্রতিবাদ জানায়। সে সময় আড়ি পাতা আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবিরের দায়ের করা একটি রিট আবেদনে হাইকোর্ট রুল জারি করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ এ বিষয়ে নীরব থাকে। আড়ি পাতা বিষয়ে এক রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ‘আড়ি পাতা ব্যক্তির গোপনীয়তায় একটি মারাত্মক আগ্রাসন’ উল্লেখ করে বলেছেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খেয়াল-খুশিমাফিক আড়ি পাতার অনুমতি দিতে পারবে না। তাকে তার প্রতিটি আদেশের উপযুক্ত ও শক্তিশালী কারণ দেখাতে হবে। কোনো আদেশের মেয়াদ অনির্দিষ্টকাল হবে না। দুই মাস মেয়াদ থাকবে। এরপর আবার কারণ দেখিয়ে উপযুক্ত কমিটি দিয়ে মেয়াদ বাড়ানো যাবে, কিন্তু তা ছয় মাসের বেশি হবে না। আবার এভাবে আড়ি পেতে যে রেকর্ড করা হবে, তা রেকর্ড করা থেকে দুই মাসের মধ্যে ব্যবহার ও ধ্বংস করে দিতে হবে। যেকোনো মূল্যে অবৈধ আড়ি পাতা এড়াতে হবে। কারো গোপনীয়তায় অনুপ্রবেশ হতে হবে ন্যূনতম।’ ১৯৯৬ সালে পিইউসিএল বনাম ভারত মামলায় বিচারপতি কুলদীপ সিং ও এস সগির আহমেদের ওই রায়ে বলা আছে, কোনো রেকর্ডের কতটি অনুলিপি হবে, কতটুকুর ট্রান্সক্রিপশন হবে, কে কে দেখতে পাবে, সেসব প্রাথমিক অনুমতির আদেশেই নির্দিষ্ট করতে হবে। টেলিফোনে আড়ি পাতার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো রয়েছে। একটি বিশেষ আদালতের অনুমতি ছাড়া সেখানে আড়ি পাতা আইনত নিষিদ্ধ। এ ছাড়া রয়েছে সিনেটরদের নিয়ে গঠিত সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটি। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত টেলিফোনে আড়ি পাতার ঘটনায় ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে বিদায় নিতে হয়েছিল। জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণার ১৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির নিজস্ব গোপনীয়, পরিবার, বাড়ি ও অনুরূপ বিষয়কে অযৌক্তিক বা বেআইনি হস্তক্ষেপের লক্ষ্যবস্তু বানানো যাবে না, তেমনি তার সুনাম ও সম্মানের ওপর বেআইনি আঘাত করা যাবে না। আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এ বিষয়ে সম্প্রতি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকেরই চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার রয়েছে। যোগাযোগের অন্য উপায়গুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে টেলিফোন। এখন মোবাইল ফোনই হচ্ছে যোগাযোগের অন্যতম উপায়। আইন সংশোধনের মাধ্যমে কাউকে ফোনে আড়ি পাতার ক্ষমতা দেওয়া হলেও সে আইনের মাধ্যমে সংবিধানের বিধান লঙ্ঘন করা যায় না। ভুক্তভোগী অনেকে বলছে, মোবাইল ফোন এখন যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হলেও এতে গোপনীয়তা রক্ষা হচ্ছে না। কেউ আড়ি পাতছে—এই আতঙ্কে অনেকে মোবাইল ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চায় না। নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় ওই সাংবিধানিক রক্ষাকবচ কোনো কাজে আসছে না। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঠিকাদারি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হকের ফোনে কথোপকথন রেকর্ড ও তা প্রচার করা হয়। নুরুল হক এ জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করেন। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটে। গত বছর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার আসামি কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপের সঙ্গে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মাসুদ ও সাবেক এসপি আল্লাহ বক্সের ফোনালাপ ফাঁস হয়। এ ধরনের ঘটনা অনেক। কিন্তু এর জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করার কোনো চেষ্টা হয় না। বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র বলেন, টেলিফোনে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা যে হুমকির মুখে, এটা শতভাগ সত্য। বর্তমান ডিজিটাল যুগে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা বা ডাটা প্রাইভেসি নিশ্চিত করা ততই দুরূহ হয়ে পড়ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও এটি বড় ধরনের একটি সংকট। তিনি আরো বলেন, মোবাইল ফোন অপারেটররা নিজেদের স্বার্থেই তাদের গ্রাহকদের তথ্য কাউকে দেয় না। কিন্তু এই নম্বর বিভিন্নভাবে অন্যদের কাছে চলে যায়। মোবাইল ফোনে বিভিন্ন অ্যাপস নেওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত পূরণ করতে হয় ব্যক্তিগত নানা তথ্য দিয়ে। এতে গ্রাহকের অজান্তেই তার তথ্য অন্য কেউ পেয়ে যায়। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে গিয়েও অনেকে ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে দিচ্ছে। চেইন সুপার শপের গ্রাহক কার্ড সংগ্রহ, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা এসবের মাধ্যমেও ব্যক্তিগত তথ্য বাইরে চলে যায়। বিটিআরসি ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, “দেশে টেলিফোন গ্রাহকদের তথ্য সুরক্ষার বিষয়ে কোনো আইন নেই। এ বিষয়ে ‘প্রাইভেসি অ্যাক্ট’ করার বিষয়ে আমরা কাজ করছি।” ফোনে আড়ি পাতা সম্পর্কে সুব্রত রায় মৈত্র বলেন, ‘এটা গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা করতে পারে। আদালতের নির্দেশেও এটা হতে পারে। এর বাইরে এটা করার এখতিয়ার কারো নেই। নিজস্ব কারিগরি ক্ষমতার মাধ্যমে এ ধরনের কাজ আর কেউ করছে কি না, সেটা আমাদের জানা নেই।’ মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন এমটবের মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফরহাদ (অব.) বলেন, অপারেটররা আইন অনুযায়ী গ্রাহকদের সব রকম তথ্য গোপনীয়তার মধ্যে রেখে সেবা প্রদান করে থাকে। ফোনে কারো আলাপচারিতা ফাঁসে মোবাইল ফোন অপারেটরদের কোনো দায় নেই।
Link copied!