বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভোজ্য তেলের বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট

প্রকাশিত: ১২:০৩ পিএম, জানুয়ারি ১৫, ২০২২

ভোজ্য তেলের বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট

ভোজ্য তেলের আমদানিকারক ও পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তরফ থেকে গত সপ্তাহে সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম বাড়ানোর জন্য নতুন করে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। তাদের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, আপাতত বাড়ানো হবে না সয়াবিন তেলের দাম। কিন্তু দাম বাড়াতে এবার নতুন কৌশল নিয়েছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। গত এক সপ্তাহ ধরে ভোজ্য তেলের সরবরাহ কমিয়ে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা হয়েছে। এমন অভিযোগ করেছেন রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা। এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই দুয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও জানান ব্যবসায়ীরা। গতকাল রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজারের মুদি দোকান ঘুরে এর সত্যতা মেলে। রাজধানীর অন্যতম বৃহৎ বাজার কারওয়ান বাজারের ইউসুফ জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. ইউসুফ জানান, নতুন বছরের একেবারে শুরু থেকেই তেল কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিরা জানিয়ে আসছিলেন আবারও দাম বাড়বে ভোজ্য তেলের। তারা জানিয়েছিলেন, এই দফায় লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হবে। আমাদের কাছ থেকে বাড়তি দামের অর্ডারও নিয়ে নেন তারা। পরে জানতে পারলাম সরকার নতুন করে দাম বাড়ানোর অনুমতি দেয়নি, কিন্তু এরপর থেকেই মিলমালিকরা বাজারে ভোজ্য তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। বোতলজাত এবং খোলাÑ উভয় ধরনের ভোজ্য তেলেরই সরবরাহ কমিয়েছেন তারা। বোতলজাত সয়াবিনের ১ লিটারের বোতল বাজারে কিছু মিললেও ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ অনেক কমিয়ে দিয়েছেন তারা। আমরা যতটা জানতে পেরেছিম এভাবে তারা বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে দাম বাড়াতে চান। শুক্রবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরেও এর সত্যতা মেলে। প্রায় প্রতিটি বাজারের মুদি দোকানে সয়াবিন তেলের সঙ্কট দেখা গেল। দোকানগুলোতে এখন চাহিদার অর্ধেক বোতলজাত সয়াবিন তেলও নেই। সর্বশেষ মূল্য অনুযায়ী ১ লিটার সয়াবিন তেলের বোতলের গায়ে মূল্য লেখা রয়েছে ১৬০ টাকা। অথচ অনেক দোকানে বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকা করে। ২ লিটার বোতলজাত সয়াবিনের মূল্য ৩১৮ টাকা। অধিকাংশ দোকানে মূল্য রাখা হচ্ছে ৩২৫ টাকা। এ ছাড়া ৫ লিটারের বোতলের গায়ে মূল্য লেখা রয়েছে ৭৬০ টাকা। ৫ লিটারের বোতল সরবরাহ কম থাকায় অনেক দোকানে বিক্রি হচ্ছে ৭৭০ টাকায়। রাজধানীর মধ্যপাইকপাড়া বউবাজারের মুন্না স্টোরের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ মুন্না বলেন, বাজারে এখন সয়াবিন তেল নেই বললেই চলে। ১ ও ২ লিটারের বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ কিছুটা আছে; কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন দেওয়া একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কোম্পানির লোকেরা এলে তারা বলেন, কারখানায় তেলের সঙ্কট, এজন্য ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন সরবরাহ করা যাচ্ছে না। মুন্না বলেন, ‘আসলে যখনই কোম্পানিগুলো তেলের দাম বাড়ানোর চিন্তা করে ঠিক তার আগ দিয়ে বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেয়। বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট দেখিয়ে তারা বলেন, বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে, তাই তেল আসছে কম। এজন্য বাজারে সরবরাহ কমে গেছে। অথচ এর দুয়েকদিন পরই দেখা যায় দাম বাড়িয়ে বোতলের গায়ে নতুন মূল্যের লেবেল লাগানো তেল দিচ্ছে তারা। আমরা আশঙ্কা করছি এবারও তারা দাম বাড়াবেন। এজন্যই তারা এই কৃত্রিম সঙ্কট করছেন। এদিকে বাজারে খোলা সয়াবিন এবং পাম অয়েলেরও সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান, কারওয়ান বাজারের পাইকারি ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী বেঙ্গল স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. ইউনুস আলী। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, টিকে গ্রুপ, এস আলম এবং সিটি গ্রুপের কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে ভোজ্য তেল কিনছি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় যেটা দেখেছি, যখনই কোম্পানিগুলো মনে করে তেলের দাম বাড়াবে তার এক সপ্তাহ আগ দিয়ে বাজারে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেয়। এসব প্রতিষ্ঠান খোলা সয়াবিন এবং পাম অয়েলের সরবরাহও প্রায় অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছে। আমার ৫টি ট্রাক এক সপ্তাহ ধরে তাদের কারখানায় বসে আছে, কিন্তু তেল সরবরাহ করা হচ্ছে না। আমরা কাছে মনে হচ্ছে, যেকোনো কৌশলেই তারা আবার দাম বাড়াবেন। মিলমালিক ও ভোজ্য তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ধরনের কৌশলকে সম্পূর্ণ হঠকারিতা বলছেন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। শুক্রবার তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তারা আবারও লিটারপ্রতি সয়াবিন তেলের দাম ৮ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন গত সপ্তাহে। মন্ত্রণালয় তাদের সে প্রস্তাবে সায় না দিয়ে জানিয়ে দেয় আপাতত দাম বাড়ছে না। সরকার যখন বলছে দাম বাড়ানো হবে না, সেখানে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে ভিন্ন কৌশল নিয়েছেন। তাদের এই অনৈতিক কাজ প্রতিহত করার দায়িত্ব সরকারের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত বাজারে এবং মিল পর্যায়ে অভিযান চালিয়ে কারা এ ধরনের কাজ করছেন তাদের খুঁজে বের করা এবং শাস্তির আওতায় আনা। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে দেশের বাজারে সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ৮ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেন ব্যবসায়ীরা গত সপ্তাহে। গত শনিবার থেকে নতুন দাম কার্যকরও করতে চেয়েছিলেন তারা। এজন্য গত ৭ জানুয়ারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে শীর্ষস্থানীয় ভোজ্য তেল বিপণনকারী সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা সে সময় জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে দেশের বাজারে প্রতিলিটার ভোজ্য তেলের দাম ১২ টাকা বৃদ্ধির একটি প্রস্তাব আমরা অনেক আগেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দিয়েছিলাম, পরে কমিয়ে ৮ টাকা করা হয়েছে। ৭ জানুয়ারি বৈঠক শেষে ভোজ্য তেলের দাম আপাতত বাড়ছে না বলে জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য) এএইচএম শফিকুজ্জামান। অতিরিক্ত সচিব জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে দেশে রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশন ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানোর আবেদন করে। তবে সরকার এখনও ভোজ্য তেলের দাম বাড়ায়নি। যাচাই-বাছাই করে এ ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত হবে। অথচ নতুন সিদ্ধান্ত আসার আগেই দাম বাড়াতে ভিন্ন কৌশল নিয়েছে সয়াবিন তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
Link copied!