বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভোটের আগে বাড়ছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ

প্রকাশিত: ০১:০৭ পিএম, মার্চ ১৯, ২০২৩

ভোটের আগে বাড়ছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ

আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। তার আগেই মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, আটজন সিনিয়র সচিবসহ প্রশাসনের মোট ২১ জন সচিবের নিয়মিত চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে অর্থাৎ অবসরে যাওয়ার সময় হচ্ছে। চুক্তিতে থাকা আরও কয়েকজন সচিবের চাকরির মেয়াদও শেষ হচ্ছে এ বছরই। ফলে চলতি বছরই ফাঁকা হচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিবের পদসহ অন্তত ২৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষ পদ। এসব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে দেনদরবার। নির্বাচনের আগেই আরও কয়েকজন কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন বলে আলোচনা আছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে। প্রশাসনের শীর্ষ এই পদগুলোর মধ্যে সর্বশেষ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেলেন বিসিএস নবম ব্যাচের কর্মকর্তা গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন এবং একাদশ ব্যাচের কর্মকর্তা রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিয়া। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ও কারিগরি পদে কোনো কারণে যোগ্য ব্যক্তি না পাওয়া গেলে জনস্বার্থেই চুক্তিতে নিয়োগ দিতে হয়। এটা অতীতেও ছিল, এখনো আছে।’ তার মতে, প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্যই সরকারকে এটা করতে হয়। তবে নতুন করে আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চান না প্রশাসনের বেশির ভাগ কর্মকর্তা। একই মত পোষণ করেন বিশ্লেষকেরাও। এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বিষয়টি আইনের খেলাপ না হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে চুক্তি-সংস্কৃতি থেকে সরে আসার সময় হয়েছে। জানা গেছে, সদ্য স্বাধীন দেশে সরকারি কর্মকর্তার অভাব দেখা দেওয়ায় ১৯৭৪ সালের সরকারি কর্মচারী অবসর আইনের আওতায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিল বঙ্গবন্ধু সরকার। কিন্তু সেই পরিস্থিতি এখন না থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আবার কখনো স্বজনপ্রীতির কারণে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ আছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরোধিতা করে ২০১৪ সালের ১ মার্চ তখনকার জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেককে চিঠি দিয়েছিলেন তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নেরও তাগিদ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতেও পাল্টায়নি পরিস্থিতি। এ বছর অবসরে যাবেন যারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যেসব সচিব এ বছর অবসরে যাবেন, তারা হলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া (৪ জুলাই) এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন (১৩ অক্টোবর)। ৩১ মার্চ চাকরির মেয়াদ শেষ হবে জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলাম খানের। এপ্রিলে বয়সসীমা শেষ হচ্ছে বিপিসি চেয়ারম্যান (সচিব) এ বি এম আজাদ ও সংস্কৃতিসচিব আবুল মনসুরের। মে মাসে অবসরে যাচ্ছেন বিসিএস প্রশাসন একাডেমির রেক্টর মোমিনুর রশিদ আমিন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, প্রতিরক্ষাসচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম ও ভূমিসচিব মোস্তাফিজুর রহমান। এ বছর আরও অবসরে যাবেন কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের ডিজি মু. মোহসিন চৌধুরী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসচিব জিয়াউল হাসান, সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আবদুস সালাম, স্বাস্থ্য সেবাসচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান আবুবকর ছিদ্দীক, অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, ইআরডি সচিব শরিফা খাতুন, শ্রম ও কর্মসংস্থানসচিব এহসানে এলাহী, মাদ্রাসা ও কারিগরি সচিব কামাল হোসেন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়কসচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মোছাম্মৎ নাসিমা বেগম, ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মো. ফয়জুল ইসলাম। এমন সচিব ও রাষ্ট্রদূতদের কয়েকজন নির্বাচনের আগেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। শীর্ষ পদে চুক্তিতে আছেন ১৩ জন বর্তমানে প্রশাসনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবসহ সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে কর্মরত ৮৫ কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে চুক্তিতে আছেন ১৩ জন। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ও কয়েকটি দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত পদেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সচিবসহ ঊর্ধ্বতন পদে চুক্তিতে আছেন ড. আহমদ কায়কাউস (ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক), আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম (এনবিআর চেয়ারম্যান), শ্যাম সুন্দর সিকদার (বিটিআরসি চেয়ারম্যান), সম্পদ বড়ুয়া (রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব); মো. আখতার হোসেন (এসডিজির মুখ্য সমন্বয়ক), মাসুদ বিন মোমেন (পররাষ্ট্রসচিব), শেখ ইউসুফ হারুন, লোকমান হোসেন মিয়া, ওয়াহিদুল ইসলাম খান, প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, মো. মোকাম্মেল হোসেন ও ফজলুল বারী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সচিব পর্যায়ে আছেন রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলম ও মাশফী বিনতে শামস্। রাষ্ট্রদূত পদে আছেন মো. আবু জাফর, কামরুল আহসান, মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, শাহাবুদ্দিন আহমদ ও জাভেদ পাটোয়ারী। আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীনসহ আরও অনেকে চুক্তিতে আছেন। চুক্তির এক নিয়োগে চার স্তরে পদোন্নতি থেমে যায় বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আবু আলম মো. শহিদ খান জানান, চুক্তিতে নিয়োগ না দিতে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও বারবার অনুরোধ করা হয়েছে। সাবেক এই সচিব আজকের পত্রিকাকে বলেন, সচিব পদে চুক্তিতে একটি নিয়োগ দিলে অন্তত চার স্তরে পদোন্নতি থেমে যায়। এতে অতিরিক্ত সচিব যেমন সচিব হতে পারেন না, তেমনি যুগ্ম সচিবও অতিরিক্ত সচিব হতে পারেন না। একইভাবে উপসচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিবেরাও পদোন্নতি বঞ্চিত হন। এ কারণে শুধু প্রশাসন নয়, সব ক্যাডারেই সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়মিত কর্মকর্তাদেরই নিয়োগ দেওয়া উচিত। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা মনে করেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে প্রশাসনের নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এতে কর্মদক্ষতা কমে যায়। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দেয়। তবে কিছু কারিগরি পদ রয়েছে, যেখানে সরকার চাইলে যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতেই পারে।’
Link copied!