মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মণ্ডলদের 'দুষ্টু গরু' সৈকত

প্রকাশিত: ১১:০৮ এএম, অক্টোবর ২৮, ২০২১

মণ্ডলদের 'দুষ্টু গরু' সৈকত

কারমাইকেল কলেজের ছাত্র না হয়েও ছাত্রলীগের ওই কলেজ শাখার দর্শন বিভাগের সহসভাপতি হয়েছিলেন পীরগঞ্জ সহিংসতার অন্যতম প্রধান হোতা সৈকত মণ্ডল। ছাত্রলীগের কথিত এই নেতার সঙ্গে ছাত্রশিবিরের যোগসাজশের কথাও আলোচিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে পাশের জেলা গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার ধাপেরহাট এলাকার জামায়াত-শিবিরের সম্পর্কের কথা। প্রশাসনিকভাবে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার চেরাগপুর থেকে ধাপেরহাটের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের মতো। পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের এই চেরাগপুর গ্রামেই সৈকতের বাড়ি। সরেজমিনে চেরাগপুরে গিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সৈকতের দাদা শতবর্ষী আবুল হোসেন মণ্ডল এখনও রামনাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং চাচা নজরুল ইসলাম মণ্ডল ওই ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। সৈকতের বাপ-চাচাদের দাবি, তাদের বাবা আবুল হোসেন মণ্ডল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার চাচাতো ভাইঝির জামাই। ১৯৭২ সাল থেকে তিনি আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন কমিটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর প্রতিকূল সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করায় এলাকায় তাদের 'মালাউন' বলে গালি সহ্য করতে হয়েছে। পীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র তাজিমুল ইসলাম শামীমও মণ্ডল পরিবারকে চেনেন বলে জানালেন। সৈকতের দাদা ও চাচা যে আওয়ামী লীগের নেতা এ বিষয়টিও নিশ্চিত করেছেন তিনি। ওয়াজেদ মিয়ার ভাইয়ের ছেলে মেয়র শামীমের কাছে মণ্ডল পরিবারের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক নিয়ে জানতে চাইলে তিনি রসিকতা করে বললেন, 'আমাদের রাবণের গোষ্ঠী।' তারপর অবশ্য বেশ গুরুগম্ভীর হয়ে বলেন, 'আমাদের অনেক বড় পরিবার, কোথায় যে কে কার আত্মীয় হয়, তার সব জানাও নেই।' পীরগঞ্জ ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক মিঠুন চন্দ্র সাহা ও সহসভাপতি সালমান সিরাজ রিজু জানালেন, সৈকত পীরগঞ্জে ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। দুই বছর আগে বিলুপ্ত কমিটির দুই নেতাই সৈকতকে কারমাইকেল কলেজে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে দেখেছেন বলে জানালেন। গত ১৭ অক্টোবর রাতে রামনাথপুর ইউনিয়নের করিমপুর মাঝিপাড়ায় সহিংসতা সৃষ্টির জন্য দায়ী যে তিনজনকে শিরোভাগে পাওয়া যাচ্ছে, তাদের একজন সৈকত মণ্ডল। অন্য দু'জন হলেন উজ্জ্বল হাসান ও রবিউল ইসলাম। ঘটনার সূত্রপাত উজ্জ্বলের একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে। ১৭ অক্টোবর দুপুরের দিকে উজ্জ্বল তার পোস্টে দাবি করেন, মাঝিপাড়ার পরিতোষ ফেসবুকের একটি মন্তব্যে কাবা শরিফের অবমাননা করেছে। পরিতোষের মা ভারতী রানি ও বাবা প্রসন্ন দাসের ভাষ্য অনুযায়ী, উজ্জ্বল ছিল পরিতোষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রসন্ন দাস বলেন, 'বন্ধুর সাথে ইয়ার্কি ফাজলামি করব্যার যায়া যদি দোষ করি থাকে, মোর ছইলের শাস্তি হইবে। কিন্তুক, এতোগুলা হিন্দুর বাড়িত হামলা-লুটপাট ক্যান হইবে, ক্যান দেওয়া হইবে আগুন?' ভারতী রানি অবশ্য তার ছেলে এমন কোনো অপরাধ করতে পারে বলে মানতে নারাজ, 'মোর ছইলটাকে উজ্জ্বল বন্ধুত্বের নাম করি ফাঁসে দিলো।' উজ্জ্বলের গ্রামের বাড়ি বড় মজিদপুরে গিয়ে পরিতোষের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা জানা গেল। বয়সে দু'জনের মধ্যে কয়েক বছরের পার্থক্য রয়েছে। তবে উজ্জ্বলের মা রোজিনা বেগম পরিতোষকে চেনেন না বলে দাবি করেছেন। উজ্জ্বল আর রবিউল নিকটতম প্রতিবেশী। তাদের গ্রাম থেকে বটেরহাটের দূরত্ব এক কিলোমিটারের মতো। রবিউল বড় মজিদপুরের আকন্দপাড়া জামে মসজিদে পাঞ্জেগানা নামাজে ইমামতি করলেও জুমার নামাজ পড়াতেন বটেরহাট মসজিদে। পরিবারের কাছ থেকেই রবিউলের আল্লাহ, আল্লাহ করে রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যাওয়ার গল্প শোনা গেল। রবিউলের বাবা মোসলেমউদ্দিন আকন্দও বিভিন্ন মসজিদে ইমামতি করেছেন একসময়। গ্রামবাসীর কাছে বাবু মৌলভি নামে পরিচিত এই মোসলেমউদ্দিন। তিনি মনে করেন, তার ছেলে ধর্মের জন্য দিওয়ানা, তবে অন্যের ওপর হামলা করার লোক নয়। উজ্জ্বলের মায়ের দাবি, ১৭ অক্টোবরের সহিংসতার সময় তার ছেলে গ্রামেই ছিল না। রবিউলের স্ত্রী শাপলা বেগম বললেন, 'মোর স্বামী ঘরোতেই আছিল। আগুন নাগার সময় আঙিনায় মোকে ডাকি নিয়া দেখাইছেনও।' রবিউল ও উজ্জ্বলের পরিবারের কেউই সৈকতকে আগে থাকতে চিনতেন না বলে দাবি করেছেন। এলাকার লোকজনও সৈকতকে দেখেননি খুব একটা। তবে এখন তার নামটি সবার জানা। চেরাগপুরের পথে এক ব্যক্তি সৈকতকে 'মণ্ডলদের দুষ্টু গরু' বলে আখ্যা দিলেন। মণ্ডলদের গ্রামে সুনাম আছে, সেটা পথে পথে মানুষের মন্তব্যে ধারণা করা গেল। পথের মানুষের দেখিয়ে দেওয়া পথে বাড়িটি খুঁজে পেতে খুব একটা সময়ও লাগল না। পরপর চারটি বাড়ির তৃতীয়টির বারান্দায় বসা ছিলেন সৈকতের বড় চাচা আবদুর রশিদ মণ্ডল। তিনি নিয়ে গেলেন দ্বিতীয় বাড়িটিতে এবং ওই বাড়িতে ঢুকতেই দেখা হলো সৈকতের বাবা রাশেদুল হক মণ্ডলের সঙ্গে। বাকি দুটি বাড়ির প্রথমটিতে সৈকতের মেজো চাচা সাদেকুল ইসলাম মণ্ডল এবং চতুর্থটিতে ছোট চাচা রেজাউল ইসলাম মণ্ডল থাকেন। সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই এ দু'জনও এসে উপস্থিত হলেন। তবে কথা বলছিলেন, সবার বড় রশিদ মণ্ডল। তিনি বলেন, 'সৈকত পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে ছোটবেলা থেকে ছাত্রলীগের সঙ্গে রাজনীতি করে আসছে। আমাদের ছেলে হয়তো অপরাধ করেছে। তাই বলে এই পরিবারটিকে জামায়াতি তকমা দেওয়ার চেষ্টা আমাদের কষ্ট দিচ্ছে।' সৈকতের চাচাতো ভাইয়েরা এ সময় ঘর থেকে একের পর এক কাগজপত্র এনে দেখাচ্ছিল, তাদের ভাইটি সত্যিকারের ছাত্রলীগ কর্মী বলেই তাকে বহিস্কার করা হয়েছে। সৈকতের মা আঞ্জুয়ারার দাবি, তার ছেলে কারমাইকেল কলেজ থেকে অনার্স পরীক্ষা দিয়েছে। তবে এ-সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র আছে কিনা জানতে চাইলে ভুল করে নিয়ে এলেন সৈকতের প্রতিবন্ধী ভাতা পাওয়ার কার্ড। কলেজের কোনো একটি কাগজপত্রও নেই বাড়িতে। সৈকত কারমাইকেল নয়, রংপুর সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী, তার শিক্ষাবর্ষ এবং পরীক্ষার রোল নম্বর, যাবতীয় তথ্য বলার পরও বাপ-চাচারা বিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকলেন। মনে হলো পুরো পরিবারটি এখনও বিশ্বাস করে তাদের ছেলেটি মিথ্যে বলেনি। এরপর আলোচনা চলে যায়, প্রতিবন্ধী কার্ড নিয়ে। চার ভাইয়ের মধ্যে সৈকতের বাবা আক্ষরিক অর্থেই নিরক্ষর। তিনি সৈকতের একটি ছবি এনে দেখালেন তার ছেলের একটি হাতের কয়েকটি আঙুল নেই। সৈকতের ছোট চাচা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল মণ্ডল বলেন, 'আমাদের ছেলে পরিতোষের শাস্তি চেয়েছে, এটা সত্যি। তবে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটে সে ছিল না। যখন মাঝিপাড়ার উত্তরাংশে আগুন দেওয়া হয়, তখন ছেলেটা ছিল দক্ষিণাংশের তেমাথার মোড়ে, পুলিশের ঘেরাওয়ের মধ্যে।' সৈকতের ছোট চাচার এই এ দাবির কোনো সমর্থন মেলেনি কোথাও। বরং সরেজমিনে বহুসাক্ষ্য মিলেছে, সৈকত মাঝিপাড়ার দক্ষিণের তেমাথায় নয়, ছিলেন উত্তরের আখিরা সেতুসংলগ্ন বটেরহাট মসজিদের সামনে। তারই পরামর্শে বটেরহাট মসজিদের ইমাম রবিউল ইসলাম মাইকিং করে সমবেত লোকজনকে উত্তপ্ত করেছেন। ফেসবুক লাইভের ভিডিও দেখে ধারণা করা হচ্ছে, এর একটি ভিডিও যার সাত সেকেন্ডের মাথায় একজনকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, 'আমাদের মুসলিম জাতি আগুনে পুড়ে শহীদ হয়ে গেল আর আমরা মুসলিম!' মাঝিপাড়ার লোকজনও এসেছিল, আগুন লাগাতে আসা মানুষগুলোর বেশিরভাগ বটেরহাট থেকে আখিরা সেতু হয়ে তাদের গ্রামে এসেছেন। সৈকত মণ্ডল পীরগঞ্জে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় উস্কানিদাতা ছিলেন বলে মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে। ২২ অক্টোবর র‌্যাব তাকে গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা (আইসিটি) আইনে র‌্যাব-১৩-এর পক্ষ থেকে একটি মামলা হয়েছে। সহিংসতার অপর একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে সৈকতের সহযোগী রবিউল ইসলামকে। মোট চারটি মামলা হয়েছে এ ঘটনায়। এর দুটি আইসিটি মামলার একটিতে পরিতোষ একাই আসামি। পরিতোষের ফেসবুক মন্তব্য স্ট্ক্রিনশট ছড়িয়ে দেওয়ার অপরাধে অন্য একটি আইসিটি মামলার আসামি দু'জন হলেন উজ্জ্বল হাসান ও আল আমিন। সহিংসতার একমাত্র মামলাটিতে ৪১ জন আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং অজ্ঞাত রয়েছে আরও অনেকে।
Link copied!