বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে টিকটকে

প্রকাশিত: ০১:০১ পিএম, জুলাই ২২, ২০২২

মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে টিকটকে

সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয় অ্যাপস টিকটক। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও বেড়েছে ‘শর্ট ভিডিও মেকিং প্লাটফর্ম’ টিকটক ব্যবহারকারীর সংখ্যা। ছোট-বড় অনেকেই আসক্ত টিকটকে। তবে আতঙ্কের বিষয় হলো, অপব্যবহারের কারণে সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি মারণফাঁদে পরিণত হচ্ছে চীনা এ প্রযুক্তি- এমন দাবিই করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি টিকটক করতে গিয়ে বাংলাদেশে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। ইতোমধ্যে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রিয়া, ওকলাহোমা ও পেনসিলভানিয়ায় ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জের কারণে তরুণদের মৃত্যু হয়েছে বলে অনেক তরুণ-তরুণী ও অভিভাবক টিকটকের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। তাই বাংলাদেশেও এ চ্যালেঞ্জের কারণেই তরুণ-তরুণীর মৃত্যু হচ্ছে কি না তা তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জ টিকটকের কোনো প্রোডাক্ট নয়, এটি টিকটকে লিঙ্ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটা বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জ : ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এমন এক ধরনের অপশন, যেখানে তরুণ-তরুণীকে তার বেল্ট অথবা অন্য কোনো মাধ্যম ব্যবহার করে ফাঁসিতে ঝুলতে বা আত্মহত্যা করতে প্ররোচনা দেয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম দ্য ভার্জের প্রতিবেদন অনুযায়ী, টিকটক ব্যবহারকারীদের নিজের বেল্ট, টাই বা অনুরূপ কিছু দিয়ে শ্বাসরোধ করতে উৎসাহিত করা হয়, যতক্ষণ না তারা এই চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হতে পারছে। গ্রাহক স্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ মোবাইল ফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে চীনা শর্ট ভিডিও মেকিং প্লাটফর্ম টিকটকের অপব্যবহার এতটা বেড়েছে যে, বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মৃত্যুফাঁদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ এ অন্যতম মাধ্যম। শুধু বিদেশেই নয়, বাংলাদেশেও চলতি বছরে টিকটক করতে গিয়ে দশ তরুণ-তরুণী প্রাণ হারিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছিলাম টিকটককে নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতার মধ্যে আনার। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করা হয়েছে। কিন্তু কেন টিকটককে জবাবদিহিতা ও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তিনি আরও বলেন, টিকটকের ভিডিও মেকিং প্লাটফর্মে ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে বিভিন্ন দেশেও প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রিয়া, ওকলাহোমা ও পেনসিলভানিয়ায় ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জের কারণে তরুণদের মৃত্যু হয়েছে বলে অনেক তরুণ-তরুণী ও অভিভাবক টিকটকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। গত কয়েক বছর ধরে টিকটকের অপব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। টিকটকের কারণে চলতি বছরে ১০ জনের মৃত্যু : বাংলাদেশ মোবাইল ফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিকটক বানাতে গিয়ে কিংবা টিকটকের কারণে চলতি বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের ৮ জুলাই অর্থাৎ কোরবানির ঈদের দুদিন আগে নোয়াখালীর চাটখিলে টিকটক ভিডিও বানানোর সময় অসাবধানতাবশত পা পিছলে গেলে সানজিদা আক্তার নামে (১১) বছর বয়সি এক কন্যাশিশুর মৃত্যু হয়। ঈদের ঠিক একদিন পর ১১ জুলাই কুমিল্লায় চলন্ত ট্রেনের ছাদে টিকটক করতে গিয়ে পা পিছলে মেহেদী হাসান (১৫) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। গত ২ মার্চ রাজবাড়ী জেলার কালোখালী উপজেলার রেল সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে টিকটক বানাতে গিয়ে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা যায় হোসেন (১৬) নামে এক কিশোর। ৮ মে নড়াইলের কালিয়ায় টিকটক করতে বাধা দেওয়ায় মায়ের সঙ্গে অভিমান করে কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করে কিশোরী সুমি আক্তার (১৯)। ১৬ মে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা শহরের লাল ব্রিজের কাছে হৃদয় (১৫) নামে এক কিশোর খুলনাগামী নকশীকাঁথা এক্সপ্রেস ট্রেনের সামনে টিকটক বানাতে গিয়ে কাটা পড়ে। ২২ মে নীলফামারীর সৈয়দপুরে টিকটক করতে গিয়ে নদীতে ডুবে মৃত্যু হয় মুস্তাকিম ইসলাম (১৬) নামে এক কিশোরের। গত বছরের ২০ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে টিকটক ভিডিও বানাতে গিয়ে নির্মাণাধীন তিনতলা ভবন থেকে পড়ে মারা যায় কিশোর অনিল (১৪)। এ ছাড়া টিকটকের কারণে চাঁদপুর ও রংপুরে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে টিকটক ভিডিও আপলোডকে কেন্দ্র করে খুন হয় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আরাফাত। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, টিকটক বানাতে গিয়ে আরও অনেক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে, যাদের সঠিক তথ্য প্রকাশ না পাওয়ায় নাম-পরিচয় তুলে ধরতে পারছি না। এসব মৃত্যুর দায়ভার কোনোভাবেই টিকটক কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে যেতে পারে না।এ ছাড়া আমাদের দেশের মোবাইল অপারেটরদের জনসচেতনতা তৈরিতে নিষ্ক্রিয়তা এবং নিয়ন্ত্রক কমিশন কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় দিন দিন বেড়েই চলেছে টিকটকের অপব্যবহার। সরকারের সাইবার সিকিউরিটি নিরাপত্তা সেলের প্রতি টিকটকের ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জ অপশন রয়েছে কি না তা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি। এদিকে একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম দ্য ভার্জ বলছে, গত বছরের জানুয়ারিতে ইতালিতে ১০ বছর বয়সি একজনের, মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে ১২ বছর বয়সি এক কিশোরের, জুনে অস্ট্রেলিয়ায় ১৪ বছরের এক কিশোরের, জুলাইয়ে ওকলাহোমায় ১২ বছরের এক কিশোরের ও ডিসেম্বরে পেনসিলভেনিয়ায় ১০ বছরের আরেক কিশোরের মৃত্যু হয়। এসব ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ টিকটকের ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জ। পেনসিলভানিয়ায় ১০ বছরের কিশোর নাইলা অ্যান্ডারসনের মা তাওয়াইনা অ্যান্ডারসন। সন্তানের মৃত্যুর পর ইতোমধ্যে টিকটকের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন। তার দাবি, এই চ্যালেঞ্জ বাচ্চাদের বিপজ্জনক কাজের দিকে ঠেলে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে আবার এমনও দেখা গেছে, কিশোররা ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জ না খুঁজে ফিল্ম দেখেই ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ একটা সময়ে টিকটকের দৌলতে খুবই ভাইরাল হয়। প্রথমত, অভিযোগ উঠেছিল কেন এই চ্যালেঞ্জ এত জনপ্রিয় একটা প্লাটফর্ম বাচ্চাদের অ্যাক্সেপ্ট করতে উৎসাহিত করছিল। দ্বিতীয়ত, টিকটক অ্যাপের মেইন স্ক্রিনে একেবারে সবার সামনে ‘ফর ইউ ট্যাবে’ রাখার অভিযোগ উঠতেও বিতর্ক বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। অভিভাবকরা দাবি করেছেন, টিকটকের ভয়ঙ্কর ‘ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জ’ অ্যাক্সেপ্ট করে তাদের সন্তানরা শ্বাসরোধে মারা গেছে। এ নিয়ে টিকটকের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে। সম্প্রতি দুটি মামলা করেছেন আট বছরের লালানি ওয়াল্টন এবং নয় বছরের আরিয়ানি আরোয়োর অভিভাবকরা। এ বিষয়ে টিকটকের একজন মুখপাত্র বলেন, এই অস্থির চ্যালেঞ্জ কখনই টিকটকের ছিল না। তার কথায়, অন্য জায়গা থেকে শুনে ব্যবহারকারীরা এই চ্যালেঞ্জে অংশ নিচ্ছিল এবং টিকটকে তার ভিডিও শেয়ার করছিল। তিনি আরও বলেন, এমন কোনো ফিচার বা চ্যালেঞ্জ টিকটক নিজে থেকে নিয়ে আসে না, প্রচার করার কোনো প্রশ্নই নেই। টিকটকের ওই মুখপাত্র বলেন, আমরা ব্যবহারকারীর নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিদানে সর্বদা মনোযোগী। এমন কোনো বিষয় আমাদের প্লাটফর্মে আবিষ্কৃত হলে যতদ্রুত সম্ভব আমরা সেটিকে সরিয়ে ফেলব। যাদের পরিবারে এমন বিরাট ক্ষতি হয়েছে, আমাদের হৃদয় পড়ে রয়েছে তাদের সঙ্গে। এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি টিকটকে ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জ বলে কিছু নেই। তবে যে ঘটনাটি ঘটতে পারে তা হলো টিকটক যখন করে অথবা ওইখানে কেউ যখন শেয়ার করে তখন হয়তো ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জের লিঙ্কগুলো দিতে পারে। বিষয়টি যখনই আমার নজরে এসেছে তখনই আমি টিকটকের সঙ্গে কথা বলছি। টিকটক আমাদের জানিয়েছে ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জ বলে কোনো অপশন নেই। হয়তো ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জ আমাদের লিঙ্কে যুক্ত হয়। ওই লিঙ্কে যেহেতু যুক্ত হয়, সে কারণে আমরা তাদের বলেছি, টিকটকে ওই লিঙ্ক যেন না থাকে এবং কোনোভাবেই যেন ব্যবহারকারীর কাছে না পৌঁছে সে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। তারা আমাদের শতভাগ আশ্বস্ত করেছে, কোনো ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হোক না কেন তারা এটি নিশ্চিত করবে, যাতে টিকটকে ব্ল্যাকআউট চ্যালেঞ্জ না থাকে। তিনি বলেন, কেউ চাইলে ফেসবুকে কিংবা ইউটিউবে লিঙ্ক দিতেই পারে। তবে প্রোডাক্টটা টিকটকের না, এটা ওরা আমাকে নিশ্চিত করেছে। প্রোডাক্ট ওদের হলে তাদের দায় ছিল, তা হলে এটা বন্ধ করার জন্য তাদের বলতে পারতাম। আমি তাদের কাছ থেকে যে ইনফরমেশন পেয়েছি সেটি আমার কাছে অথেনটিক মনে হয়েছে। এটা যে তাদের প্রোডাক্ট এটি আমরা এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। টিকটকে লিঙ্ক হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটা আমরা জানি এবং সেটি বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ যেটা নেওয়ার সেটি আমরা নিয়েছি।
Link copied!