বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

প্রকাশিত: ০৮:৪২ এএম, জুন ১৭, ২০২১

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

মন্দা বিনিয়োগে আরও বিপর্যয় নিয়ে এসেছে করোনাভাইরাস। যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। কারণ, করোনার নেতিবাচক প্রভাবে নতুন বিনিয়োগ একেবারেই কম। আর বিনিয়োগ সংক্রান্ত সব সূচকই নিম্নমুখী। গত এক বছরে ছোট, মাঝারি ও বড়-এই তিন ধরনের শিল্প খাতেই উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছোট শিল্প। আর বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য বলছে, বছরের শুরুতে বিনিয়োগ করতে কিছু নিবন্ধন হয়েছিল। তবে এই মুহূর্তে তা একেবারে কমে গেছে। আর যা নিবন্ধন হয়েছে, তা ওখানেই সীমাবদ্ধ। এর বাস্তবায়নের কার্যক্রমও শুরু হয়নি। এক্ষেত্রে করোনা না যাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে বলেছেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান। তবে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, বিনিয়োগ ও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। এছাড়া আগামী অর্থবছরেও জিডিপির ২৫ শতাংশ বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, এই পরিমাণ বিনিয়োগের জন্য অতিরিক্ত ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা লাগবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলতি (২০২০-২০২১) ও আগামী অর্থবছরে (২০২১-২০২২) বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী। করোনার সংক্রমণ অব্যাহত থাকলে বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও পৌঁছানো যাবে না। তাদের মতে, বিনিয়োগ কমা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, করোনার কারণে ‘লকডাউন’ থাকায় এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। আর বিনিয়োগে পুঁজির দুটি খাত মুদ্রা ও পুঁজিবাজার বিপর্যস্ত। ফলে আগামী দিনে কীভাবে এই বিনিয়োগ বাড়ানো যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। জানতে চাইলে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম মঙ্গলবার বলেন, করোনার কারণে মানুষ ঘর থেকে বাইরে যাচ্ছে না। ফলে করোনা যতদিন আছে, ততদিন আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। তিনি বলেন, আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। ভার্চুয়ালভাবে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। তবে অনলাইনে সবকিছু হয় না। সশরীরে আসা বা কথা বলার আলাদা একটি মূল্য আছে। তিনি দাবি করেন, বাজেটে বিনিয়োগের জন্য অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ‘আমরা দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংকও নীতিমালায় বেশকিছু ছাড় দিয়েছে। অন্যদিকে আগের যত সুযোগ ছিল, এবার সবই অব্যাহত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ বিনিয়োগ সহজ করতে সব ধরনের উদ্যোগই নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যত উদ্যোগ নেওয়া হোক, মানুষের মুভমেন্ট স্বাভাবিক না হলে বিনিয়োগ আসবে না’। জানা গেছে, একটি দেশে বিনিয়োগ হলে কয়েকটি সূচক দিয়ে তা বোঝা যায়। এর মধ্যে রয়েছে-বিনিয়োগ নিবন্ধন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন, বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি, বিদ্যুতের ব্যবহার এবং সব শেষে শিল্পের উৎপাদন। আর এসব বাড়লেই কর্মসংস্থান এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ে। বিডার তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ-তিন মাসে দেশীয় ২৯৯টি প্রকল্পে ১৩ হাজার ১৪৩ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। আগের তিন মাসের চেয়ে যা ২০ শতাংশের বেশি নেতিবাচক। পরের সূচকগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। এপ্রিল পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়ন ছিল ৪৯ দশমিক ০৯ শতাংশ। আগের বছর যা ছিল ৭৪ দশমিক ০৯ শতাংশ। এছাড়া মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৫ শতাংশ। এপ্রিল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি মাত্র ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ০১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ বছর প্রথম তিন মাসে তা কমে ২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। গত বছরের মার্চ পর্যন্ত শিল্পের কাঁচামাল আমদানি দশমিক ৭৬ শতাংশ নেতিবাচক ছিল। আর এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা ৩ দশমিক ২ শতাংশ নেতিবাচক। অন্যদিকে গত বছরে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এ বছর তা কমে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়ে ছোট শিল্পে প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে কমে মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ করোনায় ছোট শিল্প সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। গত জুন পর্যন্ত সক্ষমতার তুলনায় বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ। এ বছর তা কমে ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশে নেমেছে। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এমনিতেই বিনিয়োগে খারাপ অবস্থা ছিল। এরপর করোনার কারণে তাতে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগ বাড়ানো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। তিনি আরও বলেন, এমনিতেই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বর্তমান সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। এরপর নতুন বিনিয়োগ হওয়া খুবই কঠিন। মির্জ্জা আজিজ বলেন, শুধু সক্ষমতা নয়, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগও কমে আসছে। কারণ, আগামী দিনে বেসরকারি খাত পুঁজির সংকটে থাকবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ অর্থ জোগান দেয় ব্যাংক ও পুঁজিবাজার। আর এই দুটি খাতেরই অবস্থা খারাপ। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা। এরপর বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার এ খাত থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিচ্ছে। ফলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের টাকা পাওয়া কঠিন হবে। অর্থমন্ত্রীর সংসদে দেওয়া তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরে দেশে জিডিপির ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ ৮ দশমিক ১ শতাংশ এবং বেসরকারি খাতে ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। এ অবস্থায় ২০২১-২২ অর্থবছরে বিনিয়োগের জন্য ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ ৮ দশমিক ১ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ২৫ শতাংশ। সিপিডির মূল্যায়নে বলা হয়েছে, এই পরিমাণ বিনিয়োগের জন্য অতিরিক্ত ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি লাগবে। এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগের এই লক্ষ্যমাত্রাকে অসম্ভব বললেও উদার বিশ্লেষণ হবে। তার মতে, করোনার কারণে পুরো বছরেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক থাকবে। এই পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে থামবে, তা কেউ বলতে পারে না। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে, একটি দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য মৌলিক পূর্বশত ৭টি। এগুলো হচ্ছে : পুঁজির সহজলভ্যতা, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ, পর্যাপ্ত জমি, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহসহ উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, স্থিতিশীল কর কাঠামো, দক্ষ শ্রমিক এবং আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে সহজ ব্যবস্থাপনা। কিন্তু এসব সূচকের কোনোটিই বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিনিয়োগের অন্যতম শর্ত। বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নেই। কিন্তু অনিশ্চয়তা কাটেনি। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক রয়েছে। জানা যায়, কয়েক বছর ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতা রয়েছে। আর বিনিয়োগ বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। এ অবস্থার উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন বিডা ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ সেবা চালু করে। এই সেবার মূল কথা হলো, বিনিয়োগকারীরা এক ছাদের নিচে বিনিয়োগের সব ধরনের সুবিধা পাবেন। তবে করোনা এসে সব হিসাবে পালটে দিয়েছে।  
Link copied!