বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যতভাবে সাশ্রয় করতে চায় সরকার

প্রকাশিত: ০২:০১ পিএম, জুলাই ২০, ২০২২

যতভাবে সাশ্রয় করতে চায় সরকার

বিশ্বজুড়ে করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় অর্থনীতিতে লাগা বড় ধরনের ধাক্কার রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এ কারণে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ভাবের প্রভাবে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। চলতি অর্থবছরে সব ধরনের যানবাহন কেনা বন্ধ করার পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খরচ কমানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে উপজেলা প্রশাসনকেও। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এসব খাত থেকে চলতি অর্থবছরে সরকারের সাশ্রয় হবে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া সরকারি অর্থ সাশ্রয়ে নতুন আরও খাত খোঁজা হচ্ছে। বিলাস দ্রব্যাদি আমদানি কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। আমদানি ব্যয়ের প্রায় ২৫ ভাগই বিলাস পণ্য হওয়ায় এ খাত থেকেও বেশ অর্থ সাশ্রয় হবে বলে মনে করছে সরকার। বাজেট পাসের আগের দিন ২৯ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি ব্যয় কমানোর নানা পদক্ষেপ তুলে ধরে নাগরিকদেরও কৃচ্ছ্রসাধনের এ পরামর্শ দেন। এরপর সম্প্রতি অর্থ বিভাগ থেকে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য তিনটি এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়। অর্থ বিভাগ থেকে জারি করা ‘উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পগুলোর অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন’ শীর্ষক পরিপত্রে বলা হয়েছে, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের লক্ষ্যে, সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পগুলো ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’- এই তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। পরিপত্রে চলতি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ পাওয়া ১৪৮৭টি প্রকল্পের মধ্যে ‘এ’ ক্যাটাগরির প্রকল্প বাস্তবায়নে শতভাগ বরাদ্দ অক্ষুণ্ন রেখে ‘বি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোর বরাদ্দের সরকারি অংশের ২৫ শতাংশ কর্তন করা হয়েছে। আর ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোর অর্থ ছাড় আপাতত স্থগিত থাকবে। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপিতে বরাদ্দের পরিমাণ ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ কমানোর এ সিদ্ধান্তে এডিপি থেকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে বলে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের ধারণা। অর্থ বিভাগের ‘পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের কতিপয় ব্যয় স্থগিত বা হ্রাসকরণ’ শিরোনামে পরিপত্রে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে কিছু খাতে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয়ে সব ধরনের যানবাহন কেনা (মোটরযান, জলযান ও আকাশযান) বন্ধ থাকবে। শুধু জরুরি ও অপরিহার্য ক্ষেত্র বিবেচনায় আপ্যায়ন ব্যয়, ভ্রমণ ব্যয়, অন্যান্য মনিহারি, কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ও আসবাবপত্র খাতে বরাদ্দ করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। দেশে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ খাতে (প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ছাড়া) বরাদ্দ করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। এসব খাতে বরাদ্দ করা অর্থ অন্য কোনো খাতে যোগ করা যাবে না। আরেক পরিপত্রে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প, কর্মসূচি ও স্কিমগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মূল্যায়ন কমিটির সদস্যরা সভায় অংশ নিলে যে সম্মানী পেতেন, তার পুরোটাই বাতিল করা হয়েছে। এই দুই পরিপত্রে উল্লিখিত খাতে চলতি অর্থবছরে সরকারের প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের বাজেটে সব ধরনের যানবাহন কেনায় ৮ হাজার ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যার পুরোটাই সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া আপ্যায়ন ব্যয়সহ প্রশাসনিক ব্যয় খাতে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রয়েছে ১০ হাজার ২৬ কোটি টাকা। এখানে সাশ্রয় হবে বরাদ্দের অর্ধেক। এ ছাড়া বিলাস পণ্য আমদানির বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বছরে ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি বিলাস পণ্য আমদানি করা হয়। সরকারের ব্যয় সঙ্কোচননীতি বাস্তবায়নে উপজেলা প্রশাসনের নামে বরাদ্দ দেওয়া অর্থের অতিরিক্ত ব্যয় কমাতে ১০ দফা নির্দেশনা দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত ব্যয়ের ক্ষেত্রে ব্যয়-উত্তর অনুমোদন দেওয়া হবে না বলে বরাদ্দ করা অর্থের অতিরিক্ত ব্যয় করা যাবে না। বরাদ্দ করা অর্থ সরকারের প্রচলিত আর্থিক ও প্রশাসনিক নিয়মাবলি প্রতিপালন সাপেক্ষে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ব্যয় করতে হবে। অর্থবছরের শেষ পর্যায়ে তড়িঘড়ি করে অর্থ ব্যয় করার প্রবণতা পরিহার করতে হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক শারীরিক ও বাসভবনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ১০ জন সশস্ত্র আনসার সদস্য ছাড়া অতিরিক্ত কোনো আনসার সদস্যদের বেতন ও ভাতা এ মন্ত্রণালয়ের বাজেট থেকে পরিশোধ না করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারের ব্যয় সাশ্রয়ের নীতি বাস্তবায়নে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়া এবং সরকারি গাড়ির অপব্যবহার বন্ধে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেউ অপব্যবহার করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, খরচ কমানোর জন্য বিদেশ সফর কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, গাড়ি কেনা বন্ধ করেছি। এ ছাড়া যেসব প্রকল্প এ মুহূর্তে চালু না করলে চলে সেগুলোর অর্থায়ন আপাতত বন্ধ রাখা হবে আর যেগুলো চলমান আছে সেগুলো চলবে। এভাবে আমাদের সাশ্রয় করতে হবে। এটা প্রয়োজন হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে। এসব খাতে যে ব্যয়গুলো হতো তা সাশ্রয় হবে। এতে আমাদের ভর্তুকির খরচটা উঠে আসবে। ব্যয় কম করা সম্ভব হলে গুরুত্বপূর্ণ খাতে বেশি পরিমাণে ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হবে, যা দেশের অভ্যন্তরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে এ ধরনের আরও পদক্ষেপও নেওয়া হতে পারে বলে জানান তিনি। সরকারি অর্থে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করা হলেও বিভিন্ন প্রকল্পের টাকায় বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টাকায় কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমন করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদেশ সফর শতভাগ বন্ধ করা হয়নি। যেগুলো অপরিহার্য, দেশের জন্য প্রয়োজন সেগুলোতো যেতে হবে। কারণ সব বিদেশ ভ্রমনই তো শৌখিন ভ্রমণ নয়। এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা আমরা দেশে বসে দেখতে পারব না, বিদেশে যেতে হবে সরেজমিন দেখতে। সেক্ষেত্রে তো যেতে হবে। তবে বিদেশ সফর খুবই অপরিহার্য না হলে কেউ যাবে না। সরকারি অর্থ সাশ্রয়ে নতুন আর কোনো খাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, নতুন আর কোনো খাত এখনও ঠিক করা হয়নি। তবে বিলাস দ্রব্যাদি আমদানি আমরা কমিয়ে দিতে চাচ্ছি। এতে আমদানি ব্যয় কমে আসবে এবং ওই খাত থেকে বেশ অর্থ সাশ্রয় হবে। আমদানি ব্যয়ের প্রায় ২৫ শতাংশই বিলাস পণ্য, যেটা কোনো অপরিহার্য পণ্য নয়।
Link copied!