মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজধানীর পানিতে ৩২শ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৮:৩৮ এএম, জুলাই ৫, ২০২১

রাজধানীর পানিতে ৩২শ কোটি টাকা

ডেইলি খবর ডেস্ক: রাজধানীর ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে এক যুগে প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এরপরও জলাবদ্ধতা কমেনি। উলটো আরও বেড়েছে কয়েকগুণ। খোজ নিয়ে জানা গেছে-রাজধানীর সীমানা নির্ধারণের অজুহাতে আটকে আছে ঢাকার খালগুলোর উদ্ধার প্রক্রিয়া। যেগুলো নিয়ন্ত্রণে আছে তার অনেকগুলোই প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। পানির প্রবাহ নেই। এতে দ্রæত পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবছে রাজধানী ঢাকা। বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের কথাই বলা হচ্ছে। এখন যুগ পার হতে চলেছে একই দোহাই দিয়ে। বাস্তবে কাজ না হলেও বন্ধ নেই এ খাতের ব্যয়। টেকসই পানি নিষ্কাশনের উদ্যোগ না নেওয়ায় খালগুলোর দখল-ভরাট বেড়েছে। চারপাশের নদ-নদীর সঙ্গে খাল ও নর্দমার পানি নিষ্কাশন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পাম্পিংনির্ভর হয়ে পড়েছে ঢাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। ফলে সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যাচ্ছে ঢাকার প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি সর্বত্র। বাড়ির ভেতরও পানি ঢুকে পড়ছে। সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে রাজধানীবাসী। সরকারী টাকা রাজধানীর জলাবদ্ধতা বা বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে ভেসে বেড়ায়,দুর্ভোগ কমে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ঢাকার খাল,নর্দমা, ড্রেন সংস্কার,উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের নামে ঢাকা সিটি করপোরেশন (বর্তমানে উত্তর ও দক্ষিণ), ঢাকা ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা ডিসি অফিস কাজ করেছে। সংস্থাগুলো বিভিন্ন প্রকল্পের নামে এবং রুটিন ব্যয় হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে। এদের কাছে ব্যয়ের সঠিক হিসাবও নেই। এতকিছুর পরও ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান মেলেনি। ঢাকায় কার্পেটিংয়ের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় জলাশয়ের পরিমাণ কমে গেছে। এতে করে প্রতিবছর নতুন নতুন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে,ঢাকার বিদ্যমান ড্রেনেজ ব্যবস্থায় ঘণ্টায় ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে পানি সরতে সময় লাগছে তিন ঘণ্টা। ৫০ মিলিমিটার হলে লাগছে চার ঘণ্টা। ৭০ মিলিমিটার হলে লাগবে ১০ ঘণ্টা। প্রতিবছরের ভরা বর্ষার মৌসুমে ঘণ্টায় ৭০ মিলিমিটারের অধিক বৃষ্টিপাত হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করছে পানি নিষ্কাশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো। কিন্তু দ্রæত পানি সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তারা প্রায় নীরব। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর থেকে ২০২০-২০২১ অর্থবছর পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসা ঢাকার খাল,ড্রেন পরিষ্কার ও সংস্কারে খরচ করেছে প্রায় ৯০৬ কোটি টাকা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) যৌথভাবে খরচ করেছে ১ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) খরচ করেছে প্রায় ১০৮ কোটি টাকা। সর্বশেষ তিন বছরের ফাইলপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, খালের রুটিন সংস্কার কাজে খরচ হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। আর দুটি প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ১৫৩ কোটি টাকা। এর আগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় ২৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ২০১৩ সালে শেষ করেছে ঢাকা ওয়াসা। ঢাকার দুই সিটি ফুটপাত, ড্রেনেজ ও সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বছরে প্রায় ১০০-১৫০ কোটি টাকা খরচ করেছে। আর বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমেও দুই সিটির ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে অর্থ খরচ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতার কারণ হচ্ছে, পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক মাধ্যম বন্ধ করে কৃত্রিম প্রচেষ্টা চালানো। এখনো যতটুকু সম্ভব,প্রাকৃতিক মাধ্যম, খাল ও ডোবানালাগুলোকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে খালগুলো দুই সিটিতে হস্তান্তরের উদ্যোগ খুবই ইতিবাচক হয়েছে। এখন এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখাসহ নেটওয়ার্ক তৈরি,খালের সীমানা নির্ধারণ, দখলমুক্ত করে খনন করলে অনেকাংশে ঢাকার পানি নিষ্কাশন সমস্যার সমাধান সম্ভব। জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড.আদিল মুহাম্মদ খান বলেন,রাজধানীর জলাবদ্ধতার সমাধান করতে হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় প্রয়োজন। এটা করতেই ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে খালগুলো দুই সিটির হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকেও খালগুলো দুই সিটির কাছে হস্তান্তরের প্রচেষ্টা চলছে। এগুলো কার্যকরভাবে করা গেলে সমন্বয়হীনতার সমাধান ঘটবে। পাশাপাশি সুষ্ঠু পরিকল্পনার আওতায় পানি নিষ্কাশনের লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করলে বিদ্যমান জলাবদ্ধতা সমস্যার অনেকাংশে সমাধান মিলবে। তিনি বলেন,একসঙ্গে শহরের খাল,ডোবানালাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাধারগুলো রক্ষা ও উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কেননা এসব উৎসও বৃষ্টির পানি ধারণ করবে। তাহলে বৃষ্টি হলেই শহরে জলাবদ্ধতা হবে না। এজন্য টেকসই সমাধানের পথে হাঁটতে হবে। ইতোমধ্যে সে লক্ষ্যে তৎপরতা শুরু করেছে সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো: আতিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে খাল,ড্রেনেজের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই পরিচ্ছন্নতা ও উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। যা চলমান রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে খাল, ড্রেনেজ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হবে। তিনি বলেন, আমরা খাল পরিষ্কার করছি। আবার নগরবাসী খালে আবর্জনা ফেলছে। এভাবে তো চলতে পারে না। নগরবাসীকেও খাল,ড্রেনেজ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে। এটা বড় চ্যালেঞ্জ, সবাই মিলে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন,অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ঢাকার জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে প্রাপ্ত খাল, ড্রেন,পাম্প স্টেশনের উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ হচ্ছে। খালগুলো, দখল ও ভরাটমুক্ত করা হচ্ছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলে আশা করছি। একাধিক সূত্র জানায়,সরকারি পর্যায় থেকে ঢাকায় জলাবদ্ধতার সঠিক কারণ অনুসন্ধান না করে এতদিন বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সংস্থা নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। কিন্তু এসব উদ্যোগে সমস্যার সমাধান মেলেনি। তবে এবার স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো:তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে ২৬টি খালের দায়িত্ব দুই সিটির হাতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। অন্য সংস্থার কাছে থাকা খাল, ড্রেনেজ,পাম্পিং স্টেশনগুলোও দুই সিটিকে বুঝে দিতে চায় মন্ত্রণালয়। সে লক্ষ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আর ঢাকা ডিসি অফিসসহ অন্য কোনো সংস্থার কাছে খাল থাকলে সেগুলোও দুই সিটিকে বুঝিয়ে দিয়ে চায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। একটি সংস্থার তত্বাবধানে ঢাকার খালগুলো পরিচালিত হলে টেকসই সমাধান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সুত্র-যুগান্তর  
Link copied!