মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের পৌনে সাত কোটি টাকার কালোবিড়াল

প্রকাশিত: ০৫:৩১ এএম, এপ্রিল ৪, ২০২১

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের পৌনে সাত কোটি টাকার কালোবিড়াল

শিক্ষাপ্রকৌশল অধিদপ্তরে কালোবিড়ালে আখড়া। করোনাপরিস্থিতিতেও কালোবিড়ােেলর ভয় নেই। বরাদ্দ না থাকলেও ভুয়া বিল দাখিল করে একটি প্রকল্প থেকে উত্তোলন করা হয়েছে প্রায় পৌনে সাত কোটি টাকা। এই ঘটনা ঘটেছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঢাকা জোনে। এরকম প্রতিটি জোনেই কালাবিড়ালের হাতছানি থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্টানের উন্নয়নের কাজ হয় নিম্নমানের। এসব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময় সতর্ক করলেও চোরায় শুনছে না ধর্মের কাহিনী। ঢাকা জোনের প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানতে পেরেছে,অর্থ বরাদ্দ না থাকা সত্বেও ভুয়া বিল দাখিল করে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে একটি প্রকল্পের নামে এই জোন সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছে। এছাড়া আরো কয়েকটি প্রকল্পে একইভাবে ঢাকা জোন ভুয়া বিলের মাধ্যমে বরাদ্দের অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন করেছে বলে তারা জেনেছে। আর এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম চাপা দিতে অধিকাংশ সময় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন ঢাকা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী। ফলে রাজধানীর একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। সরকারের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্র জানায়, গত অক্টোবর মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আসা একটি অভিযোগের পর সরকারের দায়িত্বশীল উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা বিষয়টির অনুসন্ধান শুরু করেন। ইতোমধ্যে তাঁরা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি বরাদ্দ না থাকা সত্বেও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ঢাকা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম আক্তারজ্জামান ও কয়েকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ভুয়া বিল দাখিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার (সিএও) অফিসের একটি অসাধু চক্রের সহযোগিতায় সরকারের প্রায় পৌনে সাত কোটি টাকা অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন করেছে’। এর বাইরে এই জোনে আরো কয়েকটি প্রকল্পে তাঁরা একই ধরণের দুর্নীতির আশঙ্কা করছেন বলেও জানিয়েছেন। ‘তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজ সমূহের উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে দুর্নীতির ব্যাপারে তাঁরা জানতে পেরেছেন, এই প্রকল্পে ঢাকা জোনের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু সিএও অফিস থেকে চেক প্রদান করা হয়েছে ৪৬ কোটি টাকার। অতিরিক্ত ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা নির্বাহী প্রকৌশলী, সংশিষ্ট কয়েকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সিএও অফিসের অসাধু চক্রটির মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা হয়েছে বলে অনুসন্ধানকারিরা ধারণা করছেন। সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের এই ঢাকা জোন অহরহই লঙ্ঘন করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা। তাদের একাধিক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, উন্নয়ন কাজ সঠিক সময়ে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের স্বার্থে একই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে বার বার কাজ প্রদান না করা বা সময়মতো কাজ শেষ করতে পারেনি-এমন প্রতিষ্ঠানকে পুনরায় কাজ না দেওয়া। কিন্তু এ নির্দেশ মানেন না ঢাকা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী। ফলে খোদ রাজধানীর বুকেই বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো উন্নয়নের একাধিক অসমাপ্ত কাজ বছরের পর বছর পড়ে আছে। ঢাকা জোনে উন্নয়ন কাজের দরপত্র মূল্যায়ন নিয়েও অভিনব কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ এসেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। ই-জিপি দরপত্র খোলার নির্ধারিত দিনে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের দাখিলকৃত দর প্রকাশ (ডিক্লেয়ার) করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম আক্তারুজ্জামান অনেক ক্ষেত্রেই এই নিয়ম মানেন না। তিনি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কালক্ষেপন করেন এবং পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে সময় বাড়িয়ে নেন। এর ফলে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী অনেক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান অধৈর্য্য হয়ে দাখিলকৃত তাঁদের ‘টেন্ডার সিকিউরিটি’র অর্থ উত্তোলন করে নেয়। এসময় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়া হয় এই বলে যে, ওই কাজে তাঁদের আর কোনো দাবি থাকবে না। এভাবে প্রতিদ্ব›দ্বী কমিয়ে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়। দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই কালক্ষেপনের কারণে অধিকাংশ উন্নয়ন কাজই সময় মতো শেষ হচ্ছে না। ঢাকা কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজ ও সরকারি ইডেন মহিলা কলেজের একাডেমিক ভবন, সরকারি তিতুমীর কলেজের বিজ্ঞান ভবন ও একাডেমিক ভবন, সিদ্বেশ্বরী কলেজের একাডেমিক ভবন, শের-ই-বাংলা স্কুল ও কলেজ সূত্রাপুরের একাডেমিক ভবন, শের-ই-বাংলা নগরে অবস্থিত মহিলা কলেজের হোস্টেল নির্মাণ কাজ দীর্ঘ সময়ে সম্পন্ন হয়নি। মিরপুর বাংলা কলেজ,ধানমন্ডি মহিলা কলেজ, ভিকারুন্নেসানূন কলেজসহ ঢাকা জোনের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজ দীর্ঘ দিন যাবৎ পড়ে আছে। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঢাকা জোনে কর্মরত রয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম আক্তারুজ্জামান। এই সময়ে তিনি নামে বেনামে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে সরকারের কোনো নিয়মই এখন আর তোয়াক্কা করেন না। গত জানুয়ারিতে সিঙ্গাপুর সফরকালে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের বিদেশ ভ্রমণের সরকারি অনুমতি নেননি। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, ঢাকা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী এ কে এম আক্তারুজ্জামান বলেন,একটা ভুল হয়েছিল। আমরা অতিরিক্ত বিল জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু যে অর্থ বরাদ্দ ছিল তাই প্রদান করা হয়েছে। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আপনারা অতিরিক্ত ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা উত্তোলন করে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়েছেন। জবাবে তিনি বলেন, তাহলে তো অডিট আপত্তি দিত। একে এম আক্তারুজ্জামানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, আপনার ঢাকা জোনের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজ স্থবির হয়ে আছে কেন? জবাবে তিনি বলেন, এখানে একটা গ্যাপ আছে। আসলে আমাদের কাজগুলো দুই ফেজে হচ্ছে। প্রথম ফেজে পাঁচ তলা করার অনুমোদন ছিল। এখন তা দশ তলা করা হচ্ছে। এ কারণে এ অবস্থার তৈরি হয়। তবে বর্তমানে কাজগুলো শেষ পর্যায়ে। তাঁর সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সিঙ্গাপুর ভ্রমণে সরকারের অনুমতি ছিল বলে দাবি করেন। অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলনের ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজ সমূহের উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক আসফাকুক সালেহিন বলেন, এ ধরনের ঘটনার কোনো তথ্য তিনি জানেন না। একাধিক শিক্ষক বলেন অধিদপ্তরে কালোবিড়াল মুক্ত না হলে দুর্নীতি কখনোই কমবে না। করোনায় থামেনি দুর্নীতি।
Link copied!