শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিবগঞ্জে বজ্রপাতে নিথর ১৬ বরযাত্রী

প্রকাশিত: ০৮:০৪ এএম, আগস্ট ৫, ২০২১

শিবগঞ্জে বজ্রপাতে নিথর ১৬ বরযাত্রী

আট থেকে ১০টি বাঁশের খুঁটি। এসব খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে শুধুই টিনের চালা, ছিল না বেড়া। ঝুম বৃষ্টিতে উত্তাল পদ্মায় নৌকায় না থেকে ওই টিনের চালার ঘরটিকে ‘নিরাপদ’ ভেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা। কে জানত, টিনের চালার ঘরটিতেই থাকবে মৃত্যুদূত! সেখানে এক বজ্রাঘাতে নিমিষেই থেমে যায় ১৬ জনের জীবনগাড়ি। তাঁরা সবাই ছিলেন বরযাত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের দক্ষিণ চরপাকা এলাকায় গতকাল বুধবার দুপুরে ঘটে এই মর্মন্তুদ ঘটনা। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১২ জন। জানা যায়, গত সোমবার শিবগঞ্জের পাকা ইউনিয়নের চরপাকা দক্ষিণপাড়া তেররশিয়া গ্রামের হোসেন আলীর মেয়ের বিয়ে হয় সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের জনতাহাট খড়িবোনা গ্রামের শরিফুল ইসলামের ছেলে আল মামুনের সঙ্গে। নববিবাহিত বর-কনে দুজনই ছিলেন কনের বাবার বাড়িতে। গতকাল বুধবার কমপক্ষে ৩০ জন বরযাত্রী বউভাতে যোগ দিতে নৌকায় করে যাচ্ছিলেন কনের বাড়ি। বরযাত্রীরা আর কয়েক মিনিট পরই পৌঁছে যেতেন গন্তব্যে। হঠাৎ বৃষ্টির কারণে নিরাপত্তার জন্য নৌকা থেকে নেমে তাঁরা আশ্রয় নেন খোলা একটি টিনের চালায়। নৌকাতেও ছিলেন কয়েকজন। তাঁরা ভিজছিলেন বৃষ্টিতে। একসময় বৃষ্টির সঙ্গে শুরু হয় বজ্রাঘাত। আর তাতেই প্রাণ হারান টিনের চালার নিচে থাকা ১৬ জন। ঘাটের ওই টিনের চালার ঘরের আশপাশে তেমন লোকজন ছিল না। ওই ঘাট থেকে পাশের গ্রামের দূরত্বও ৫০০ গজ। ঘটনার কিছুক্ষণ পর গ্রাম থেকে লোক এসে উদ্ধার ও চিকিৎসার জন্য ছোটাছুুটি শুরু করে। স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ৯ জনকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতাল ও একজনকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। বাকিদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এদিকে ঘটনাস্থল দুর্গম চর হওয়ায় ফায়ার সার্ভিস এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর গাড়ি যেতে দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়। মারা যাওয়া ব্যক্তিরা হলেন শিবগঞ্জের পাকা ইউনিয়নের দক্ষিণ পাকা তেররশিয়া গ্রামের মৃত সোহবুল হকের ছেলে রফিকুল ইসলাম (৬০), সদর উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের ডালপাড়ার সৈয়ব আলীর ছেলে তোবজুল আলী (৭০), তোবজুলের স্ত্রী জমিলা (৫৮), ছেলে সাদল আলী (৩৫), জামালের মেয়ে লেচন (৫০), রফিকুলের ছেলে বাবলু (২৬), বাদলের ছেলে বাবু (২০), একই উপজেলার সূর্য নারায়ণপুরের ধুলু মিয়ার ছেলে সজীব (২২), সাহালাল বাবুর স্ত্রী মৌসুমী (২৫), কালুর ছেলে আলম (৪৮), মোস্তফার ছেলে পাতু (৪০), চর সূর্য নারায়ণপুরের টিপুর স্ত্রী বেবি (৩২), ফাটাপাড়া গ্রামের সাদিকুলের স্ত্রী টকি বেগম (৩০), চর বাগডাঙ্গা গোঠাপাড়ার সাত্তারের ছেলে সহবুল (৩০), বাবুডাইং এলাকার মকবুলের ছেলে টিপু সুলতান (৪৫) ও সুন্দরপুর এলাকার সেরাজুলের ছেলে আসিকুল ইসলাম ডাকু (২৪)। মৃত ১৬ জনের মধ্যে সাতজন পরস্পরের নিকটাত্মীয়। প্রত্যক্ষদর্শী ফাতেমা বেগম বলেন, বজ পাতের আগে বিদ্যুৎ চমকায়, তবে এমন কিছুই সেখানে ঘটেনি। বরং হঠাৎ কোথা থেকে যেন বড় একখণ্ড আগুনের গোলা এসে পড়ে আমাদের ওপর। আর সেখানেই সবাই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আল্লাহ যাতে কাউকে এ রকম কষ্ট আর না দেন। শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সাকিব-আল-রাব্বি জানান, বৌভাতের অনুষ্ঠানে যাওয়া দলটির সবাই উপজেলা সদরের নারায়ণপুর ইউনিয়নের অধিবাসী। তাঁরা সুন্দরপুর ইউনিয়ন আলীমনগর ঘাট থেকে পদ্মা নদীতে নৌকায় চেপে পাকা ইউনিয়নে যাচ্ছিলেন। দক্ষিণ চরপাকা এলাকায় এলে শুরু হয় বৃষ্টি। এ সময় ঘাটেই একটি টিনের চালার নিচে আশ্রয় নেন তাঁরা। সেখানেই বজ াঘাতে তাঁদের মৃত্যু হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জাকিউল ইসলাম বলেন, মারা যাওয়া প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। আহতরাও চিকিৎসার জন্য সহায়তা পাবেন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাশ দাফনে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। শিবগঞ্জ থানার ওসি ফরিদ উদ্দিন জানান, মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাকিব আল-রাব্বি, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম ও শিবগঞ্জ থানার ওসি ফরিদ হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এদিকে পদ্মাপারে বরের গ্রামের সূর্য নারায়ণপুরে চলছে মাতম। শুধু বরের বাড়ি নয়, যেন শোকাচ্ছন্ন পুরো গ্রাম। বাড়ির সামনে স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে বাতাস। এ ঘটনায় বরের বাবা, নানা, নানি, মামা, মামি, চাচাতো ভাই-বোন, বোন-দুলাভাইও মারা যান। বজ্রাঘাতে নিকলীতে দুই জেলের মৃত্যু : এদিকে কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের নিকলীতে হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রাঘাতে দুই জেলের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো দুজন। গত মঙ্গলবার রাত ১টার দিকে উপজেলার কারপাশা ইউনিয়নের শহরমূল গ্রামের পেছনে বড় হাওরে এ ঘটনা ঘটে। মারা যাওয়া দুজন হলেন উপজেলার কারপাশা ইউনিয়নের আউলিয়াভিটা গ্রামের মৃত আসলাম উদ্দিনের ছেলে জলহু মিয়া (৫০) ও একই গ্রামের গাছগড়িয়াহাটির খেলু মিয়ার ছেলে শফিকুল (৩৫)। জানা যায়, রাতে বেড়জাল দিয়ে গ্রামের আট থেকে ৯ জেলে বড় হাওরে মাছ ধরছিলেন। মাঝরাতে শুরু হয় বৃষ্টি। এ সময় বজ পাত হলে নৌকায় থাকা চারজনের শরীর ঝলসে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই দুইজন মারা যান।
Link copied!