তিনটি শর্তে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে সম্প্রতি জামিন দিয়েছেন আদালত। তবে এই জামিন বাতিল চেয়ে সোমবার হাইকোর্টে আবেদন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অন্যদিকে সম্রাটকে চিকিৎসা দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) দায়িত্বশীলরা বলছেন, সম্রাটের উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন, তাই পরিবার চাইলে তাকে দেশের বাইরে নিতে পারবে।
এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্রাটকে কেন্দ্র করে একরকম মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে দুদক ও বিএসএমএমইউ। যত কিছুই হোক আদালতের সিদ্ধান্ত ছাড়া সম্রাট বিদেশে উড়াল দিতে পারবেন না বলে মনে করছেন তারা। তবে সম্রাটের জামিনে মুক্তি একটা ভিন্ন রকম ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের ধারণা, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে নতুনত্বের হাওয়া লাগতে পারে শিগগিরই। ইতোমধ্যে সম্রাটের মুক্তির কারণে তার এক সময়ের আধিপত্যের বিভিন্ন এলাকা, যুবলীগের নেতৃত্ব, বিভিন্ন ক্লাবপাড়াও সরব হয়ে উঠতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
সম্রাটের উন্নত চিকিৎসা দরকার- বিএসএমএমইউ : সোমবার সকালে সংবাদ সম্মেলন করে বিএসএমএমইউর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, সম্রাটের উন্নত চিকিৎসা দরকার। তার এ চিকিৎসা দেশেও হতে পারে, বিদেশেও হতে পারে। তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিতে আরও ৩-৪ দিন সময় লাগবে। সম্রাটের হার্টের অবস্থা এখনও স্বাভাবিক নয়। তার চিকিৎসার বিষয়ে বোর্ড সভা হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য পরিবার চাইলে তাকে দেশের বাইরে নিতে পারবেন।
বৃহস্পতিবার বিএসএমএমইউর কার্ডিওলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রায়হান মাসুম মণ্ডল বলেন, দূর থেকে তার (সম্রাট) কন্ডিশন দেখলে মনে হবে তিনি সুস্থ একজন মানুষ বসে আছেন। কিন্তু একটু অনিয়ম হলে তার বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। যেকোনো ধরনের স্ট্রেস রোগীর রোগ বাড়িয়ে দেয়। হৃদরোগের সঙ্গে এটি আরও বেশি সম্পৃক্ত। তাকে প্রিজনভ্যানে যখন নিয়ে আসা হতো, তখন তিনি অন্যরকম হয়ে যেতেন।
সম্রাটের জামিন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে দুদকের আবেদন : সম্রাটের জামিন বাতিল চেয়ে সোমবার হাইকোর্টে আবেদন জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজহারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ আবেদন জানানো হয়। আজ এই আবেদনের ওপর শুনানি হবে বলে জানিয়েছেন দুদকের সিনিয়র আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
বিএসএমএমইউর বক্তব্য আদালতের নজরে আনবে দুদক : সম্রাটের বিরুদ্ধে দুদকের মামলায় আদালতের জামিন আদেশে তিনটি শর্তের মধ্যে প্রথম দুটি শর্ত হলো- আদালতের অনুমতি ছাড়া দেশ ত্যাগ করতে পারবেন না সম্রাট এবং জমা দিতে হবে পাসপোর্ট। তিন নম্বর শর্ত- সম্রাটের স্বাস্থ্যগত পরীক্ষার প্রতিবেদন আগামী ধার্য তারিখে জমা দিতে হবে। এ সম্পর্কে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সময়ের আলোকে বলছেন, ‘আদালতের আদেশের প্রতি কতটুকু সম্মান দেখাচ্ছে বিএসএমএমইউ। এটি নিয়ে আমার প্রশ্ন রয়েছে। বিষয়টি আমরা অবশ্যই আদালতের নজরে আনব। শুনানিতে এ বিষয়ে আমরা আদালতকে সব কিছুই বলব।’
আইন কী বলে? : চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী, অসুস্থ সম্রাটকে এখন বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে হলে অবশ্যই আদালতের অনুমতি নিতে হবে। এ বিষয়ে আইন কী বলেছে? এমন প্রশ্নে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, জামিন বাতিলের জন্য দুদক যেহেতু হাইকোর্টে আবেদন জানিয়েছে, তাই চিকিৎসার প্রয়োজনে সম্রাটকে বিদেশে যেতে হলে এখন হাইকোর্টেই আবেদন জানাতে হবে। বিষয়টি এখন আর নিম্ন আদালতে নেই। জামিনের প্রথম শর্ত যেহেতু বিদেশ যেতে মানা, তাই আদালতের অনুমতি ছাড়া বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই।
শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি হাসপাতাল বিএসএমএমইউতে দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তির চিকিৎসা নেওয়া এবং তাদের চিকিৎসার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ সম্মেলন করা ও মেডিকেল বোর্ড গঠনের অনেক নজির রয়েছে। তবে কোনো আসামিকে নিয়ে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের এই প্রথম কোনো সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকও স্বীকার করেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘সম্রাটের বিষয়টি একটু ভিন্ন হওয়ায় তার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে হয়েছে।’
আলোচিত মামলার আসামি সম্রাটকে কেন্দ্র করে সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, যেদিন সম্রাট জামিন পেলেন, ওইদিন দুপুর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত অনেক সাংবাদিকের ফোন কল রিসিভ করতে হয়েছে আমাকে। তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সম্রাটের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। আলাদা আলাদা তথ্য দেওয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। তাই হাসপাতালের সিনিয়রদের নিয়ে বসে পরামর্শপূর্বক সংবাদ সম্মেলন করে এক সঙ্গেই সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের উত্তর আমরা দিয়ে দিই।
বিএসএমএমইউর পরিচালক বলেন, সম্রাট আমাদের হাসপাতালের একজন রোগী। তার উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। এমন কোনোদিন নেই যে আমরা রোগীদের চিকিৎসার প্রয়োজনে বোর্ড গঠন করি না। তাই এটি আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমেরই অংশ। এ ছাড়া সম্রাটের বিষয়ে আদালত যে আদেশ দিয়েছেন, তার কপি আমরা হাতে পাইনি। সেটি পেলে এ বিষয়ে আমাদের করণীয় নির্ধারণ করব। তিনি আরও বলেন, সম্রাটের হার্টে যথেষ্ট সমস্যা পাওয়া গেছে। জানতে পেরেছি, ১৯৯৮ সালে সিঙ্গাপুর থেকে হার্টে কৃত্রিম মেটালিক ভালভ লাগিয়ে এসেছিলেন তিনি। এ ছাড়া তার শরীরে আরও রোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে সম্রাটের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, দুদক যেহেতু হাইকোর্টে সম্রাটের জামিন বাতিলের আবেদন করেছে এবং মঙ্গলবার সেই শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে, তাই শুনানির পর তার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, আদালত সম্রাটের জামিনের ক্ষেত্রে যে তিনটি শর্ত দিয়েছেন তার মধ্যে একটি হলো দেশ ত্যাগ না করা। তাই হাইকোর্ট আজ যে সিদ্ধান্ত দেবেন সে অনুযায়ী পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।
গত ১১ মে সব মামলায় জামিন পাওয়ার পর মুক্তি পান ক্যাসিনো কাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাবের হাতে গ্রেফতার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। ঢাকা মহানগর বিশেষ জজ আদালত-৬-এর বিচারক আল আসাদ মো. আসিফুজ্জামান তাকে জামিন দেন। আদালত তিন শর্তের পাশাপাশি সম্রাটের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা মুচলেকা গ্রহণ করেন। আগামী ৯ জুন পর্যন্ত এ জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত।
২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম ২ কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ৮৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর আগে ক্যাসিনো কাণ্ডে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর সম্রাটকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে গ্রেফতার করে এলিটফোর্স র্যাব।