বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাংবাদিক হাবীবের মৃত্যু: এক বছরেও রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ

প্রকাশিত: ১২:৫৯ পিএম, জানুয়ারি ১৯, ২০২৩

সাংবাদিক হাবীবের মৃত্যু: এক বছরেও রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ

দৈনিক সময়ের আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হাবীব রহমানের ‘রহস্যজনক’ মৃত্যুর ঘটনায় এক বছর পূর্ণ হচ্ছে বৃহস্পতিবার। হাবীব রহমান স্মরণে সময়ের আলোর কার্যালয়ে ও গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় মিলাদ মাহফিল ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। গত বছর ১৮ জানুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে হাতিরঝিলে ‘রহস্যজনক’ভাবে মৃত্যুর পর স্বজনরা অভিযোগ করেন, হাবীব রহমানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে এক বছরেও এ মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। যে পথ দিয়ে হাবীব রহমান বাসায় যাচ্ছিলেন ওই সময় সেখানে বেলচা হাতে কয়েকজনকে দেখা গেলেও তাদের এই এক বছরে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। বেলচা হাতে তিন যুবকের যাওয়ার দৃশ্য সিসি ক্যামেরা ফুটেজেও দেখা গেছে। তারপর আরও তিনটি স্থান থেকে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ পাওয়া যায়। দুটি ভিডিওতে দেখা গেছে, হাবীব রহমান দুটি স্থানে কিছুক্ষণের জন্য থেমেছেন। আরেকটি ভিডিওতে হাতিরঝিলে প্রবেশ করা দৃশ্যে দেখা গেছে, স্বাভাবিকভাবেই মোটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ওই সময় থেকে এক মিনিটের পথ পরই তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। গত বছরের ১৯ জানুয়ারি হাতিরঝিল থানায় অপমৃত্যু মামলা করেন হাবীব রহমানের স্বজনরা। এরই মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছেন তিনজন। চতুর্থ তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বুধবার বলেন, অপমৃত্যুর মামলাটির তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তার মৃত্যু হয়েছে দুর্ঘটনায়। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে তাই এসেছে। এসব বিষয় নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন শিগগিরই আদালতে জমা দেবেন তিনি। ভিসেরা রিপোর্ট এসেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার জানা মতে ভিসেরার জন্য আবেদন করা হয়নি। তারপরও নিশ্চিত হয়ে বলা যাবে। আমি বাইরে আছি, বৃহস্পতিবার রাতে বিস্তারিত বলতে পারব। গত বছর ১৯ জানুয়ারি ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. ফারহানা ইয়াসমিন। ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন প্রস্তুতের পর তা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করে ফরেনসিক বিভাগ। প্রতিবেদনে চিকিৎসকরা মতামত দেন- ‘আঘাতের কারণেই’ হাবীব রহমানের মৃত্যু হয়েছে। তার শরীরে কোনো বিষক্রিয়া বা অ্যালকোহলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে হাবীবের শরীরের আঘাতের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি প্রতিবেদনে, অর্থাৎ হত্যা নাকি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে তা প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেনি ফরেনসিক বিভাগ। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে চিকিৎসকরা উল্লেখ করেন, হাবীব রহমানের মৃত্যু আঘাতজনিত। তার চোয়াল এবং নাকের হাড় ভাঙা ছিল। চোয়ালে ২ ইঞ্চি বাই ১ ইঞ্চি ক্ষত পাওয়া গেছে। হেমাটোমা পাওয়া গেছে মস্তিষ্কে, যার আনুমানিক আকার ২ ইঞ্চি বাই ১ ইঞ্চি (হেমাটোমা বলতে সাধারণত মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ার পর রক্ত জমাটবাঁধাকে বোঝায়)। ময়নাতদন্ত সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলেন, হেমাটোমা অনেক ধরনের হতে পারে। তবে এপিডুরাল হেমাটোমা মানে এক ধরনের রক্তক্ষরণ, যা মস্তিষ্কের ডুরা ম্যাটার আবরণী ও কুটির মধ্যবর্তী স্থানে সংঘটিত হয়। হাবীবের মস্তিষ্কের বাম পেরিটাল এবং অপটিক্যাল অঞ্চলে সাবডুরাল এবং সাব আর্চনয়েড হেমারেজ দেখা গেছে। এ ছাড়া এক থেকে দেড় ইঞ্চি জখম পাওয়া গেছে কপালের বাম পাশে। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ওপরের ঠোঁট ও নাকের মধ্যবর্তী স্থানে ৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ১ ইঞ্চি প্রস্থের কাটা জখম পাওয়া গেছে, যা মাংস ভেদ করে হাড়ে গিয়ে ঠেকেছে। নাক-মুখ থেকে অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। এ ছাড়া দুই মাড়ির বেশ কয়েকটি দাঁত ভেঙে স্থানচ্যুত হয়েছে। জিহ্বা কাটা ছিল। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাংবাদিক হাবীব রহমানের মৃত্যুর মূল রহস্য এখনও উদঘাটিত হয়নি। তবে বেশ কিছু ক্লু সংগ্রহ করে তদন্ত চলছে। হাবীব রহমান যেদিন মারা যান সেই রাতে কোথায় এবং কাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন, তাদের বক্তব্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বক্তব্যগুলো ১৬১ ধারায় জবানবন্দি হিসেবে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে। এ ছাড়াও ঘটনাস্থল থেকে যারা রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন তাদেরও জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। ঘটনার দিন র‌্যাবের একটি টহল দল উপস্থিত থেকে হাবীবকে উদ্ধার করে প্রাইভেটকারে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওই প্রাইভেটকারে থাকা তিন যুবকেরও জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। হাবীব রহমানের ‘রহস্যজনক’ মৃত্যুর ঘটনার পরপরই সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি চত্বরে মানববন্ধন করে ঢাকাস্থ কুমিল্লা সাংবাদিক ফোরাম। মানববন্ধনে সাংবাদিক নেতারা বলেন, হাবীব রহমানের মৃত্যুকে ঘিরে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। দ্রুত তদন্ত করে তার মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করার দাবি জানান সাংবাদিক নেতারা। উল্লেখ্য, গত বছরের ১৮ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর হাতিরঝিল সিদ্দিক মাস্টারের ঢাল এলাকায় হাবীব রহমানের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। পুলিশের ধারণা, দুর্ঘটনায় হাবীব রহমানের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার পর হাতিরঝিলের বিভিন্ন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে ঘটনাস্থলের ফুটেজটি অকার্যকর দেখা যায়। অন্য কয়েকটি ফুটেজে ঘটনাস্থল থেকে তিন যুবককে বেলচা হাতে হেঁটে যাওয়ার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হলে অনেকেই এটিকে হত্যাকাণ্ড বলে মন্তব্য করেন।
Link copied!