শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১

সুদিনেও সংগঠন গোছাতে পারছে না আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ০২:১৩ এএম, নভেম্বর ২৭, ২০২০

সুদিনেও সংগঠন গোছাতে পারছে না আওয়ামী লীগ

কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় ১৯৯৬ সালে। গত দুই যুগে বিভিন্ন সময় কমিটির ১৩ জন মারা গেছেন, তিনজন বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন, বেশ কয়েকজন নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। মাত্র ৮-১০ জন নেতা সক্রিয় আছেন। তাঁরাই কোনো রকমে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। একই ধরনের অবস্থা পিরোজপুরের নেছারাবাদ, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, নীলফামারীর জলঢাকা, নোয়াখালীর হাতিয়াসহ অন্তত ৬২ উপজেলা আওয়ামী লীগের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেও তৃণমূলে দল গোছাতে পারছে না আওয়ামী লীগ। দলটির ৬৫০ উপজেলা, থানা ও পৌরসভা কমিটির মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মেয়াদোত্তীর্ণ। দলটির গঠনতন্ত্রে তিন বছর পর পর সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা বলা হলেও কোথাও ২৫, কোথাও ২৪, কোথাও ২০ বছর আগে সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ অনেক উপজেলা সম্মেলন করেছিল। এরপর কয়েক দফা সরকার পরিবর্তন হলেও তিন বছর মেয়াদি ওই উপজেলা কমিটিগুলোর নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়নি। ফলে একদিকে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ঝিমিয়ে পড়েছে, অন্যদিকে তরুণ নেতারা হতাশ হয়ে সংগঠন বিমুখ হয়ে পড়ছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংরক্ষিত তথ্য, দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এবং বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের আট বিভাগে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক উপজেলা, থানা ও পৌর কমিটির সংখ্যা ৬৫০টির মতো। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৬০টি, চট্টগ্রামে ১২৮টি, রাজশাহীতে ৮১টি, খুলনায় ৭৪টি, রংপুরে ৬৬টি, বরিশালে ৫৩টি, সিলেটে ৪৯টি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৯টি। সূত্রগুলো জানায়, গত বছর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের আগে ১৩৮টির মতো উপজেলা, থানা ও পৌরসভা কমিটির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর বাইরে ৬৫০টি কমিটির অন্তত ৫০০টিরই সম্মেলনের তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে অন্তত ৬২টির সম্মেলন হয়েছে ১৫ থেকে ২৫ বছর আগে। ছয় থেকে ১৪ বছর আগে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল অন্তত ১৬৫টি উপজেলা, থানা ও পৌরসভার। তিন বছরের বেশি ও পাঁচ বছরের মধ্যে সম্মেলন হয়েছে ২৫০-২৮৫টির। ফলে অন্তত পাঁচ শতাধিক কমিটির সম্মেলনের নির্ধারিত মেয়াদ তিন বছর পেরিয়ে গেছে। বেশ কয়েকটি উপজেলা ও থানায় কমিটিই নেই আওয়ামী লীগের। ১৫-২৫ বছর আগে সম্মেলন হয় যেসব শাখার : ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ জেলায় আওয়ামী লীগের কমিটিগুলোর সবচেয়ে বেহাল দশা। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২ এপ্রিল ১৯৯৭ সালে, কিশোরগঞ্জ পৌরসভা কমিটির ১৯৯৫ সালে, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সালে। পাকুন্দিয়া উপজেলা আহ্বায়ক কমিটি হয় ১৮ আগস্ট ২০০০, করিমগঞ্জের আহ্বায়ক কমিটি ২০০২, ইটনায় ২১ মার্চ ২০০৫, মিঠামইন ২০ মার্চ ২০০৫, অষ্টগ্রাম ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৫ এবং নিকলী ২৯ মার্চ ২০০৫ সালে। পাকুন্দিয়ার আহ্বায়ক কমিটি ছিল ৭৩ সদস্যের। এর মধ্যে দুই যুগ্ম আহ্বায়কসহ ২৫ জন মারা গেছেন। আহ্বায়ক এ এস এম ওবায়দুল্লাহ পদত্যাগ করেছেন। কটিয়াদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল ইসলাম গোলাপ বছর খানেক আগে মারা গেছেন। করিমগঞ্জের ৪৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির অন্তত ১৩ জন মারা গেছেন। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৩ সালের ২১ নভেম্বর। এ ছাড়া জেলার একাধিক উপজেলায় ২০ বছরের বেশি সময় আগে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয় ১৬ বছর আগে ২০০৪ সালের ৫ নভেম্বর। রংপুর বিভাগের নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার সম্মেলন হয় ২০০৪ সালে। রাজশাহী বিভাগের কয়েকটি উপজেলায় দীর্ঘদিন সম্মেলন হয়নি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে ২০০৫, নাটোরের মান্দায় ২০০৫ সালের ১২ মে, পাবনার চাটমোহর উপজেলা কমিটি হয় ৩০ জুলাই ২০০৩ সালে। খুলনা বিভাগের মেহেরপুর পৌরসভায় ৭ আগস্ট ২০০৩, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা ২০০৪ সালের ১০ জানুয়ারি, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয় ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা, চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা এবং দামুড়হুদা উপজেলা কমিটির সম্মেলন হয় ২০০৪ সালে। বরিশাল বিভাগের পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় ২৩ বছর আগে ১৯৯৭ সালে। ময়মনসিংহ বিভাগের অনেকগুলো উপজেলায় আওয়ামী লীগের বেহাল দশা। নেত্রকোনার বারহাট্টা ২০০৩ সালে, পূর্বধলায় ২০০৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, ময়মনসিংহ সদর ২০০৩ সালের ৫ জুন, নান্দাইল ২০০৫ সালের ২৭ মে, ঈশ্বরগঞ্জ ২০০৩ সালের ১৩ মার্চ, গৌরীপুর ২০০৩ সালে, ভালুকা ২০০৩ সালের ৩ ডিসেম্বর, ফুলবাড়িয়া ২০০৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ পৌর কমিটি ২০০৩ সালের ১২ অক্টোবর, ছাতকে ২০০০ সালের ১ অক্টোবর সম্মেলন হয় এবং বর্তমানে কমিটি নেই, সিলেট সদরে ২০০৫ সালে, গোলাপগঞ্জ ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর, মৌলভীবাজার পৌরসভা ২০০৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম বিভাগের অনেকগুলো শাখায় সম্মেলন নেই দীর্ঘ বছর। কুমিল্লার দেবীদ্বারে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, চাঁদপুর মতলব দক্ষিণ ২০০৩ সালে, হাইমচর ২০০৩ সালের ১৮ জুলাই, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ ২০০৫ সালে, হাতিয়া ২০০৪ সালে, লক্ষ্মীপুর সদর ২০০৩ সালের ১ আগস্ট, রায়পুর ২০০৩ সালের ৩ আগস্ট, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ১৯৯৬ সালে, বন্দরে ৮ ডিসেম্বর ২০০৫ সালে কমিটি গঠন করা হয়। সম্মেলন ছাড়াই ডবলমুরিংয়ে ২০০২ সালে, পাঁচলাইশে ২০০৬ সালে, খুলশীতে ২০০৪ সালে এবং বাকলিয়ায় ১৯৯৮ সালে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তরের একটি তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অন্তত ৩৪৫ উপজেলা, থানা ও পৌরসভা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে ২০০৮ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে। অর্থাৎ এসব কমিটির সম্মেলন পাঁচ থেকে ১২ বছর আগে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তালিকায় দেখা যায়, এসব উপজেলার বেশির ভাগের সম্মেলন হয়েছে ২০১২ ও ২০১৩ সালে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংরক্ষিত একটি তালিকা অনুসারে ১৫-২০টি উপজেলা ও থানায় আওয়ামী লীগের কমিটি নেই। এগুলোর মধ্যে আছে—লালমনিরহাট সদর, জয়পুরহাটের কালাই, মহিপুর, বরিশাল মহানগরের কোতোয়ালি, কাউনিয়া, বিমানবন্দর, বন্দর, ফুলপুর, সিলেট মহানগরের কোতোয়ালি, জালালাবাদ, শাহপরান, এয়ারপোর্ট, দক্ষিণ সুরমা থানা। গত বছরের ২০ ও ২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক চিঠিতে তৃণমূলের নেতাদের ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন, ওয়ার্ডসহ সংগঠনের সর্বস্তরের মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলনের নির্দেশনা দেন। কিন্তু এ নির্দেশনা পালন করেননি তৃণমূলের নেতারা। বিগত জাতীয় সম্মেলনের আগে মাত্র দুটি জেলার অধীন সব উপজেলা, থানা ও পৌরসভার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাগেরহাটের ১০ শাখার সব এবং সাতক্ষীরার আট শাখার সবগুলোর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য : টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেও তৃণমূল সংগঠনের সম্মেলন করতে না পারা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১২ বছর ধরে কমিটি নেই এমন শাখার কথা আমার জানা আছে। এর বেশি পুরনো কমিটির তথ্য জানি না। যাই হোক, এগুলো আমরা চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করব।’ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের কার্যক্রমের ভেতরে কিছু ব্যত্যয় আছে। এগুলো নিয়েই কাজ করতে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিন। তৃণমূলে সম্মেলন না করে শুধু ওপরের দিকে সম্মেলন করলে তো নতুন, যুগোপযোগী নেতৃত্ব সৃষ্ট হবে না। পুরনোদের যেমন রাখতে হবে, তেমনি নতুনদেরও সুযোগ দিতে হবে। ফলে যেসব জায়গায় আমাদের সম্মেলন হয় নেই, সংগঠনের অভ্যন্তরে সমস্যা আছে, সেই জায়গাগুলোতেই আমরা নাড়া দিচ্ছি।’ সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘স্থানীয় কিছু সমস্যা থাকে যে কারণে কিছু কিছু ইউনিটে সময়মতো কাউন্সিল করা যায় না। তবে আমি মনে করি, সব কিছুর ঊর্ধ্বে হলো আন্তরিকতার অভাব। যেসব ইউনিটের নেতারা কাউন্সিল করতে ভয় পান তাঁরা আসলে দল ও দায়িত্বের প্রতি আন্তরিক নন।’
Link copied!