শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন চাচা'র প্রশ্রয়ে জিতু ছিল বেপরোয়া

প্রকাশিত: ০৮:০৭ এএম, জুলাই ১, ২০২২

সুমন চাচা'র প্রশ্রয়ে জিতু ছিল বেপরোয়া

বান্ধবীর সামনে হিরো সাজতে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের ওপর হামলা চালায় বখাটে ছাত্র আশরাফুল আহসান জিতু। অনেক দিন ধরেই এক স্কুলছাত্রীর সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খলভাবে চলাফেরা করত সে। উৎপলকে মারার তিন দিন আগে স্কুল প্রাঙ্গণে ওই ছাত্রীর সঙ্গে জিতুকে অশালীন অবস্থায় দেখতে পান শিক্ষক। ওই সময় তিনি জিতু ও তার বান্ধবীকে এই পথ থেকে সরে এসে পড়াশোনায় মন দিতে পরামর্শ দেন। এর ব্যত্যয় হলে ওই ছাত্রীকে প্রতিষ্ঠান থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। তবে শিক্ষকের উপদেশ ও শাসন ভালো লাগেনি তার, ভালো লাগেনি জিতুরও। উল্টো বান্ধবীর কাছে নিজের 'বীরত্ব' দেখানোর জন্য শিক্ষককে টার্গেট করে। জিতু দশম শ্রেণির ছাত্র আর তার বান্ধবী একই প্রতিষ্ঠানের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। জিতুকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে। ওই জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য উঠে আসে। জিজ্ঞাসাবাদ থেকে আরও জানা যায়, জিতুর এমন বেপরোয়া জীবনযাপনের পেছনে রয়েছে তার 'প্রভাবশালী' আত্মীয়দের আশ্রয়-প্রশ্রয়। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এসব তথ্য জানান। এদিকে গতকাল ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির অ্যাডহক কমিটি স্থগিত করেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। কেন, কার প্রশ্রয়ে দিনের পর দিন বখাটেপনা ও সেই এলাকায় কিশোর গ্যাং চালানোর সাহস হয়েছিল- এমন প্রশ্নে জিতু জানায়, আশুলিয়ায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডিতে তার এক চাচা রয়েছেন। তিনি সভাপতি পদে ছিলেন। তাঁর নাম মাহরুফ আলী সুমন। জিতুর ওই চাচা এলাকায় 'সুমন চাচা' নামে পরিচিত। এর আগেও একাধিকবার তাঁর বিরুদ্ধে গভর্নিং বডির কাছে উৎপল অভিযোগ জানালেও কেউ তা আমলে নেয়নি। সুমনের প্রভাবের কারণে সব জেনেও তাঁর ভাতিজা জিতুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস দেখায়নি কেউ। র‌্যাবের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, সর্বশেষ তিন দিন আগে উৎপলকে পেটানোর চূড়ান্ত টার্গেট করে জিতু। ঘটনার দিন স্টাম্প এনে লুকিয়ে রাখে। তবে জিতুর ঘনিষ্ঠ পাঁচ/ছয় বখাটে বন্ধু স্টাম্প দেখে ফেলে। কী কারণে স্টাম্প আনা হয়েছে- এটা জানতে চাইলে জিতু বলে, 'আজ উৎপলের মাথা ফাটাব। ও নাকি আমার বান্ধবীকে স্কুল থেকে টিসি দেবে।' এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্কুল পরিচালনা পর্ষদ ২২ সদস্যের ছিল। এর মধ্যে ৪ জন জিতুর পরিবারের। এ ছাড়া ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজটি জিতুর পরিবারের সদস্যরা প্রতিষ্ঠা করেন। এ কারণে ওই স্কুলে নানা অপকর্ম করলেও তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য ছিল। ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম বলেন, ২২ সদস্যের গভর্নিং বডিতে পদাধিকার বলে আমি সদস্য ছিলাম। এটি মাহরুফ আলীদের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক আবু তালেব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, জিতু প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতি মাহরুফ আলী সুমনের ভাতিজা। তার প্রভাবেই ওই শিক্ষার্থী বেপরোয়া আচরণ করত। এদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, শিক্ষককে হামলায় অভিযুক্ত ছাত্র এলাকায় 'জিতু দাদা' নামে পরিচিত। একটি কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেয় সে। স্কুল প্রাঙ্গণে মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দিত। শিক্ষকদের সামনেই ধূমপান করত। ইউনিফর্ম ছাড়া স্কুলে আসা-যাওয়া ছিল তার। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নিহত শিক্ষক উৎপল কুমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ২০১৩ সালে আশুলিয়ার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ওই কলেজের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের স্কুল ইউনিফর্ম, চুল কাটা, ধূমপান, ইভটিজিংসহ শৃঙ্খলা ভঙ্গজনিত নানা বিষয়ে ভূমিকা রাখতেন। এ ছাড়া তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা পরিচালনা করতেন। স্কুল চত্বরে উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরার কারণে জিতুকে বহুবার শিক্ষক উৎপল সতর্ক করেছিলেন। এ কারণেই সে শিক্ষকের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জিতু শ্রীপুরের নগরহাওলা গ্রামের বন্ধুর বাড়িতে আত্মগোপনে ছিল। তাকে গ্রেপ্তারের পর তার জুনিয়র দাখিল পরীক্ষার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা হয়। সেখানে তার জন্ম তারিখ আছে ২০০৩ সালের ১৭ জানুয়ারি। সে অনুযায়ী তার বয়স ১৯ বছর। কিন্তু মামলার এজাহারে লেখা ১৬ বছর। তার শিক্ষাজীবনে বিভিন্ন সময় বিরতি ছিল। উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরায় বিরতি গেছে পড়ালেখায়। তার পরিবার প্রথমে তাকে স্কুলে ভর্তি করে। পরে তাকে জোর করে মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়। এরপর তাকে আশুলিয়ায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির নেতৃবৃন্দের কয়েকজন জিতুর আত্মীয়স্বজন। এখানে ভর্তি হয়েও উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরা করত সে। র‌্যাব বলছে, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ জুন জিতু ক্রিকেট স্টাম্প নিয়ে স্কুলে আসে এবং শ্রেণিকক্ষের পেছনে লুকিয়ে রাখে। কলেজমাঠে ছাত্রীদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলাকালে শিক্ষক উৎপল কুমার মাঠের এক কোণে একা দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় স্টাম্প দিয়ে প্রথমেই পেছন দিক থেকে শিক্ষকের মাথায় আঘাত করে। অতর্কিতে তাকে বেধড়ক পেটাতে থাকে জিতু। পরে স্কুল প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে। ঘটনার দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সে এলাকায় অবস্থান করে। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে অবস্থান বদল করতে থাকে। ৫ দিনের রিমান্ড: বৃহস্পতিবার জিতুকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের আবেদন করে সাভার থানা পুলিশ। আবেদনের সঙ্গে জিতুর জন্মসনদ ও জেএসসি পরীক্ষার সনদ সংযুক্ত করা হয়, যাতে তার বয়স ১৯ বছর দেখা যায়। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব হাসান মামলাটি শিশু আদালতে পাঠিয়ে দেন। শিশু আদালত তার সনদ পর্যালোচনা করে তাকে প্রাপ্তবয়স্ক সাব্যস্ত করে মামলাটি আবার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠান। এরপর উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে জিতু আহসানকে পাঁচ দিন পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন আদালত।
Link copied!