‘নিকাহ মিসার’ বা ‘শর্তহীন বিয়ে’র সংখ্যা বাড়ছে মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীল দেশ সৌদি আরবে।
প্রচলিত ব্যয়বহুল আয়োজনে বিয়ের বিকল্প হিসেবে ‘নিকাহ মিসার’ অসচ্ছল মুসলিম পুরুষদের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু ইদানীং সৌদি সমাজে গোপনে এ ধরনের বিয়ে ‘স্বামীর দায়িত্বহীনতার বোঝা হয়ে’ চেপে বসছে বিপুলসংখ্যক নারীর জীবনে।
দেশ-ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণভাবে আজীবন সম্পর্কের প্রত্যাশা নিয়ে বৈবাহিক জীবনে পা রাখে দম্পতিরা।
কিন্তু নিকাহ মিসার বা শর্তহীন বিয়ে এমন এক চর্চা, যেখানে সাময়িক বন্ধনে আবদ্ধ হন মুসলিম নারী-পুরুষ। তারা স্বামী-স্ত্রী হয়েও প্রচলিত অনেক বৈবাহিক অধিকার ও কর্তব্য স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেন।
ছেড়ে দেয়া অধিকার ও কর্তব্যের তালিকায় আছে স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে থাকা, একাধিক স্ত্রী থাকলে সমানভাবে রাত্রিযাপন, স্ত্রীর ভরণপোষণ, তার বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, স্ত্রীর বাড়িতে স্বামীর অবাধ যাতায়াত ইত্যাদি।
বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনে জানানো হয়, সৌদি আরবে এ ধরনের শর্তহীন বিয়েকে আইনি বৈধতা দেয়া হয় কয়েক দশক আগে। অন্যান্য আরব রাষ্ট্রেও বিয়ের এ রীতি বৈধ।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, স্ত্রী হিসেবে অধিকারহীন ও তাদের প্রতি দায়বদ্ধতামুক্ত এ বিয়ের অন্যায় সুবিধা নেন অনেক সুযোগসন্ধানী পুরুষ। যাবতীয় গোপনীয়তা আর লজ্জার ভার কেবল নারীদের।
বেশ কয়েকজন মিসার দম্পতি ও ঘটকের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে, সৌদি নারীদের অবিবাহিত আর বিবাহিত সম্পর্কের মাঝামাঝি এক ধরনের সংকর হিসেবে দেখা হয় মিসার বিয়েকে। এতে লাভবান হন বহুগামী পুরুষরা। একাধিক স্ত্রী থাকলেও একাধিক সংসারের খরচ কিংবা দায়িত্ব নেয়ার চিন্তা করতে হয় না তাদের।
পুরুষদের অন্যায় সুবিধা নেয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অবশ্য জেনেবুঝে অনেক নারীও মিসার বা বন্ধনহীন বিয়েতে আগ্রহী হন। কিন্তু কেন?
প্রচলিত বৈবাহিক সম্পর্কের যে পুরুষতান্ত্রিক প্রত্যাশা, তা এড়াতে মিসার বিয়ে বেছে নেন কিছু নারী।
এ ছাড়া বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্ককে ধর্মীয় বৈধতা দিতেও মিসার বিয়ে বেছে নেন অবিবাহিত অনেক মুসলিম নারী-পুরুষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চল্লিশোর্ধ্ব সৌদি সরকারি কর্মকর্তা ত্রিশোর্ধ্ব বিধবা নারীর সঙ্গে দুই বছর ধরে শর্তহীন এ বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ।
তিনি বলেন, ‘মিসার বিয়েতে স্বস্তি আছে, স্বাধীনতা আছে। একই সঙ্গে এটা ধর্মীয় বিধিসম্মত সম্পর্ক।’
প্রচলিত নিয়মেও বিয়ে করেছেন এই ব্যক্তি। এই সংসারে তার তিনটি সংসারও আছে। তাদের সঙ্গেই থাকেন তিনি।
যখন নিজের ইচ্ছে হয়, তখন রিয়াদে শর্তহীন মিসার স্ত্রীর বাড়িতে যান তিনি। গোপন ওই বিয়েতে তার স্ত্রীর স্বার্থ কী, তা অবশ্য জানা যায়নি।
তিনি বলেন, ‘আমার এক বন্ধু ১১ বার মিসার বিয়ে করেছে। একজনকে ছেড়ে আরেকজনকে বিয়ে করে সে। এরপর তাকেও ছেড়ে দিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করে। এভাবেই চলছে।’
‘যৌতুক দিতে হয় না’
সৌদি নাগরিকদের পাশাপাশি রাজতন্ত্রে বসবাসরত অনেক প্রবাসী শ্রমিকও ডেটিং অ্যাপ আর বিয়ের পাত্র-পাত্রী খোঁজার ওয়েবসাইটে নিয়মিত ঢুঁ মারেন।
রিয়াদের চল্লিশোর্ধ্ব এক মিসরীয় ফার্মাসিস্ট বলেন, ‘মিসার বিয়ে সস্তা। কোনো যৌতুক দিতে হয় না; কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই।’
গত বছর করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর সময় নিজের স্ত্রী ও পাঁচ বছর বয়সী ছেলেকে দেশে পাঠিয়ে দেন তিনি। কারণ জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছিল। তার ওপর গত কয়েক বছরে প্রবাসীদের জন্যও শুল্কও ধার্য করেছে সৌদি সরকার।
তিনি আরও বলেন, “স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে থাকা কঠিন। তাই মিসার স্ত্রী খুঁজছি। ইনস্টাগ্রামে ‘খাতবা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ৫ হাজার সৌদি রিয়াল দিয়েছি। কেমন ওজন আর আকৃতির নারী পছন্দ আমার, গায়ের রং কেমন হতে হবে, তা জানিয়েছি। এখন পর্যন্ত কাউকে খুঁজে পাইনি।”
২০১৮ সালে সৌদি আরবের আইন মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে দেশটির আল-ওয়াতান পত্রিকা জানিয়েছিল. সাধারণত মিসার বিয়ে বেশিদিন স্থায়ী হয় না। বেশিরভাগ বিয়ে ১৪ থেকে ৬০ দিনের মধ্যেই ভেঙে যায়।
কিছু নারী মনে করেন, অবিবাহিত কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া বা বিধবা নারীদের একাকিত্ব কাটানোর ক্ষণস্থায়ী উপায় মিসার বিয়ে।
রিয়াদে বসবাসরত এক সিরীয় নারীর (যার বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে) এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানান, সাবেক স্বামীকে ভয় পান বলে ওই নারী গোপনে একজনের সঙ্গে মিসার বিয়ের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন।
কারণ হিসেবে জানান, ওই নারীর সাবেক স্বামী সৌদি নাগরিক। বিচ্ছেদের পর স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন জানতে পারলে আগের সংসারের দুই সন্তানকে নিয়ে যেতে পারেন সাবেক স্বামী।
সৌদি আরবে এ ধরনের বিয়ের সংখ্যা কত, তার কোনো হিসাব নেই। বেশিরভাগ বিয়েরই কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই।
সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতারা জানান, ১৯৯৬ সালের পর থেকে দেশটিতে এ ধরনের বিয়ে বাড়তে শুরু করে। কারণ সৌদি আরবের তৎকালীন গ্র্যান্ড মুফতি সে সময় মিসার বিয়েকে ইসলামসম্মত বলে বৈধতা দেন।
কিন্তু এ ধরনের গোপন বিয়ের নৈতিক ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকে। কারণ ইসলাম ধর্মে বিয়ের অন্যতম প্রধান মূলনীতিই হলো প্রকাশ্য বৈবাহিক সম্পর্ক।
তার ওপর শর্তহীন বৈবাহিক সম্পর্কের ফলে জন্ম নেয়া সন্তানদের স্বীকৃতি না দেয়ার ঘটনাও রয়েছে অনেক।
২০১৯ সালে সৌদি গেজেটে কলামিস্ট তারিক আল-মাইনা লেখেন, ‘কোনো দায়িত্ব পালন বা খরচ ছাড়াই একাধিক জীবনসঙ্গী বেছে নেয়ার সুযোগকে বৈধতা দিয়েছে মিসার।
‘অনেক সৌদি পুরুষ বাড়ির বাইরে সন্তানের পর সন্তান জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু খরচ ও দায়িত্ব সামলানোর ভয়ে তাদের পিতৃপরিচয় দিচ্ছে না। এ ধরনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।’
মিসার বিয়েতে জন্ম নেয়া সন্তানকে অস্বীকার করার কিছু ঘটনায় আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন অনেক সৌদি নারী।
আবার প্রচলিত বিয়েতে আবদ্ধ অনেক নারী তার স্বামীর মিসার রোমাঞ্চের কথা জানতে পারলেও বিষয়টি উপেক্ষা করে যান।
কেউ প্রতিবাদ করতে চাইলেও সামাজিকভাবে তাদের নীরব থাকতেই উৎসাহ দেয়া হয়।