বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদি থেকে নিঃস্ব হয়ে ফিরছেন প্রবাসীরা

প্রকাশিত: ১০:৫০ এএম, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২১

সৌদি থেকে নিঃস্ব হয়ে ফিরছেন প্রবাসীরা

৩৪ দিন সৌদি আরবের জেলে থাকার পর খালি হাতে, খালি পায়ে দেশে ফিরেছেন চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জের মো. রেজাউল হক। তার মতো আরও ৭৫ জন গত ১৭ সেপ্টেম্বর ফিরেছেন খালি হাতে। বিমানবন্দরে তাদের অনেককেই দেখা গেছে খালি পায়ে। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই সৌদি থেকে ফিরছেন কর্মীরা। রেজাউল বলেন, ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা ধারদেনা করে ২০২০ সালে ফ্রি ভিসায় সৌদি আরবে গিয়েছিলাম ভাগ্য ফেরাতে। ছিলাম ১৮ মাস। যে আশা নিয়ে গিয়েছিলাম, সৌদি পৌঁছার পরপরই তা ফিকে হয়ে যায়।   তিনি বলেন, যে কোম্পানির ভিসা দেওয়া হয়েছিল সেখানে পৌঁছার পর কোম্পানির কেউ রিসিভ করেনি। দালাল রিসিভ করে বাসায় রেখেছে। করোনার কারণে ৬ মাস বসে থাকতে হয়েছে। যে বেতনের কথা বলে নেওয়া হয়েছিল তা পাওয়া যায়নি। দালাল নানা কাজের কথা বলেছে কিন্তু সে তা দিতে পারেনি। অনেক সমস্যা, কেউ কোনো সহযোগিতা করে না। তারপরও বাধ্য হয়ে কম বেতনে কাজ করতে হয়েছে। ১৮ মাসের মাথায় পুলিশ ধরে মামলা দিয়ে জেলে দিয়েছে। ৩৪ দিন জেলে থাকার পর খালি হাতে বাংলাদেশে আসি। তিনি বলেন, আমি জেলে ৩৬ নম্বর রুমে ছিলাম, সেখানে ছিল ৩৭০ জন বাংলাদেশি। এই জেলে হাজারের অধিক বাংলাদেশি আছে বলে জানান তিনি। সবার একই অবস্থা। তিনি বলেন, সেখানে আকামা থাকলেও কফিলের বাইরে কাজ করলে পুলিশ ধরে জেলে দিচ্ছে, তারপর দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ ধরলে কফিল কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না। কফিলও ধরিয়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন, ধারদেনা করে বিদেশে গিয়েছিলাম। একদম খালি হাতে ফিরেছি। যারা ফিরেছে তাদের পায়ে স্যান্ডেলও নেই। ব্যাগসহ সব জিনিসপত্র সেখানে রেখে আসতে হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি কারও সৌদিতে যাওয়া উচিত নয়। সৌদি এখন আর আগের মতো নেই। সেখানে ১০ টাকাও কারও কাছে চেয়ে পাবেন না, বাংলাদেশে চাইলে পাবেন। লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি ২০০০ সালে ভাগ্য অন্বেষণে সৌদি আরবে যান। সেখানে নানা কাজ করার পর একটি বোরকার দোকান দেন। কিন্তু ভাগ্য হয়তো তার সহায় হয়নি। ২০২০ সালে এক দিন বাসা থেকে বের হলে তাকে কোনো কারণ ছাড়াই পুলিশ ধরে কাঁচামাল বিক্রির মামলা দিয়ে জেলে পাঠায়। ২৮ দিন জেল খেটে ঢাকায় ফেরত আসেন খালি হাতে। এতে তার ৩০ লাখেরও বেশি টাকা লস হয়। তিনি বলেন, আমার সব কাগজপত্র ঠিক ছিল। পুলিশ তা দেখেও আমাকে জেলে দেয়। দোকান মালিক কোনো সহায়তা করেনি। সবকিছু ফেলে আমাকে খালি হাতে দেশে ফিরতে হয়েছে। এর জন্য বাংলাদেশের সৌদি দূতাবাসকে দায়ী করেন তিনি। তিনি বলেন, আমাদের দূতাবাস বাংলাদেশি প্রবাসীদের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারছে না বলেই এমন হচ্ছে। অথচ ভারত-পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের প্রবাসীদের সঙ্গে পুলিশ এমন আচরণ করে না। ফেরত আসা কর্মীদের অভিযোগ, কারও কারও আকামার মেয়াদ থাকার পরও পুলিশ ধরে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে দিচ্ছে। জেল থেকেই এয়ারপোর্টে নিয়ে বিমানে তুলে দিচ্ছে। এ ছাড়া ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, বাসা থেকে মার্কেটে যাওয়ার সময় পুলিশ ধরেছে কিন্তু কফিল দায়িত্ব নিচ্ছে না। সৌদিতে বৈধ-অবৈধ উপায়ে যাওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে দেশটির প্রশাসন অবৈধ শ্রমিক রাখতে চাচ্ছে না। পুলিশ প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে ধরছে। অনেক বৈধ শ্রমিককেও ধরে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। জেদ্দায় বাংলাদেশের লেবার কাউন্সিলর মো. আমিনুল ইসলাম জানান, জেদ্দার ৭টি প্রভিন্সের ৩১টি জেলে এখন পর্যন্ত (২০ সেপ্টেম্বর) ৩৫০ জন বাংলাদেশি আছেন। তারা নানা মেয়াদে সাজা খাটছেন। প্রবাসী কর্মীদের খালি হাতে ফেরার বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে জানা নেই। এমন কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাইনি। এখানে শরিয়াহ আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে ঘটে। অপপ্রয়োগ হওয়ার সুযোগ নেই। আমার মনে হয়, যাদের ফোর্স করে দেশে পাঠানো হচ্ছে তারা সৌদি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরবে গেছে আড়াই লক্ষাধিক শ্রমিক। ২০০০ সালে গেছে ১ লাখ ৬১ হাজার। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপপরিচালক (গবেষণা, পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ) জাহিদ আনোয়ার জানান, সৌদিতে এখন প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী আছেন। মধ্যপ্রাচ্যে আছেন প্রায় ৫০ লাখ। ২০২০ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে ফিরেছেন ৪ লাখ ২৫ হাজার লোক। আর ২০২১ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ফিরেছেন ২০ হাজার। দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, সৌদির পুলিশ প্রবাসী বাংলাদেশিদের ধরে জেলে পাঠায়, আবার জেল থেকে সরাসরি বিমানে তুলে দেয়। পুলিশ যাদের ধরে পাঠায় তাদের কোনো তথ্য দূতাবাসগুলোর কাছে নেই। কারণ পুলিশ সেসব ঘটনা দূতাবাসগুলোকে অবহিত করে না। প্রবাসী মন্ত্রণালয় ও ওয়েজ কল্যাণ বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, কতজন প্রবাসী বিদেশে যাচ্ছেন তার হিসাব রাখা হলেও কারা ফিরছেন তার হিসাব রাখা হয় না। এটা রাখা কঠিন, কেননা ইমিগ্রেশন ও সিভিল অ্যাভিয়েশন কোনো ডাটা শেয়ার করে না। ফেরত আসাদের হিসার রাখার কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। বিদেশ ফেরত কর্মীদের নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। সংস্থাটির ইনফরমেশন ম্যানেজার আল আমিন নয়ন জানান, ব্র্যাকের পুনরেকত্রীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে যারা ফিরে এসেছেন তাদের বিভিন্ন ট্রেনিং ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কাউকে ক্ষুদ্র ব্যবসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। কারও জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধে সৌদি আরবের কারাগারে ৬ শতাধিক বাংলাদেশি আটক আছেন। এদের কারও বিচার সম্পন্ন হয়েছে, কারও বিচার চলমান রয়েছে। এদের দেশে ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের সৌদি দূতাবাস। জেল ছাড়াও ডিপোর্টেশন সেন্টারেও আটক আছেন অনেক বাংলাদেশি কর্মী। রেসিডেন্সি আইন বা লেবার আইন ভঙ্গের অপরাধে যাদের ডিপোর্ট করা হয় তাদের ডিপোর্টেশনে রাখা হয়। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পাঠানো জুন মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রিয়াদ ডিপোর্টেশন সেন্টারে অবস্থান করছেন ৭৩৯ জন বাংলাদেশি। এ বিষয়ে রিক্রুটিং এজেন্সিজ ঐক্য পরিষদের সভাপতি এম টিপু সুলতান বলেন, এক ভিসায় গিয়ে আমাদের কর্মীরা অন্য কাজ করে, এটা সৌদি আইনের লঙ্ঘন। এমন অভিযোগও আমরা পাই যে, সৌদি পুলিশ ধরার পর যাচাই না করেই জেলে দিয়ে কর্মীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। অন্যায়ভাবে যাতে কর্মীদের ধরে না পাঠাতে পারে এ জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সৌদির দূতাবাস আমাদের কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এমন অভিযোগ থাকবেই। সৌদিতে এখন একটু কড়াকড়ি চলছে। যে হারে সৌদিতে আমাদের কর্মীরা যাচ্ছেন সেই তুলনায় ফিরে আসার সংখ্যা খুবই নগণ্য। এ বিষয়ে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাফরিজা শামা বলেন, যারা অফিসিয়ালি আমাদের কর্মী, মেয়াদ শেষের আগে তাদের এভাবে পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু কেউ যদি আইন লঙ্ঘন করে তাহলে সেই দেশের পুলিশ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, এটাই স্বাভাবিক। সেই দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের চুক্তিতে (এমওইউ) এই শর্তগুলো থাকে।
Link copied!