শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্ত্রী ও ভাইয়ের হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেন

প্রকাশিত: ১১:৪১ এএম, অক্টোবর ২০, ২০২১

স্ত্রী ও ভাইয়ের হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেন

১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন নজরুল ইসলাম। দীর্ঘ ২৩ বছর চাকরি করে চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে অবসরে যান। তার সরকারি চাকরির পূর্বের সঞ্চয় ও চাকরি জীবনের সঞ্চয় এবং অন্যান্য আয় ২ কোটি ৩৮ লাখ ১৩ হাজার ৯৩৭ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) হিসাব দাখিলে ৮ কোটি ৩৮ লাখ ১৩ হাজার ৯৩৭ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণী দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ২ কোটি ৩৮ লাখ ১৩ হাজার ৯৩৭ টাকা বৈধ আয় হলেও বাকি ৬ কোটি টাকা মানি লন্ডারিং এবং দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অর্জন করেছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে মনে হয়েছে। এ ঘটনায় স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অবসরপ্রাপ্ত) মো. নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলার অপর আসামিরা হলেন- নজরুলের স্ত্রী সৈয়দা তামান্না শাহেরীন ও তার ভাই সৈয়দ হাসান শিবলী। সংস্থার প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক আশীষ কুমার কুণ্ডু ১৯ অক্টোবর মঙ্গলবার এ মামলা করেন। দুদকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, নজরুল ইসলামের স্থাবর সম্পদের হিসাবে নিজ নামে পল্লবী এলাকায় একটি জমির মূল্য ১ লাখ ৯ হাজার ৮০০ টাকা, দিয়াবাড়ী এলাকায় একটি জমি ১০ লাখ ২৯ হাজার ৬০০ ও অন্যটি ১৮ লাখ টাকা এবং ঝিনাইদহে হেবামূলে পাওয়া ২.৮০ শতাংশ জমির মূল্য ৬ লাখ ৯৪ হাজার টাকাসহ স্থাবর সম্পত্তির মূল্য ২৯ লাখ ৩৯ হাজার ৪০০ টাকা দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে, অস্থাবর সম্পদ হিসেবে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের ঢাকার প্রিন্সিপাল শাখায় ১৪টি ব্যাংক হিসাবে জামানত হিসেবে মোট ৮ কোটি এবং যমুনা ব্যাংক লিমিটেডের ঢাকার বৈদেশিক বাণিজ্য শাখায় ৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৭ টাকাসহ সর্বমোট ৮ কোটি ৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৭ টাকার তথ্য পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাবে মোট ৮ কোটি ৩৮ লাখ ১৩ হাজার ৯৩৭ টাকার তথ্য পাওয়া যায়। দুদক জানায়, ২০১০-১১ করবর্ষে নজরুলের স্ত্রী তামান্না শাহেরীনের কাছ থেকে ২ কোটি টাকা ও ২০১৯-২০ করবর্ষে ৪ কোটি টাকাসহ মোট ৬ কোটি টাকা দান হিসেবে নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এর গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। দুদক জানায়, অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তার স্ত্রী সৈয়দা তামান্না শাহেরীন গৃহিণী ও তার খামার বা মৎস্য চাষের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ কারণে স্বামীকে ৬ কোটি টাকা দানের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ নজরুল ইসলামের মোট ৮ কোটি ৩৮ লাখ ১৩ হাজার ৯৩৭ টাকার সম্পদের মধ্যে ২ কোটি ৩৮ লাখ ১৩ হাজার ৯৩৭ টাকা বৈধ আয় এবং বাকি ৬ কোটি টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে।   দুদক জানায়, ইষ্টার্ন ব্যাংকে ২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র এক বছরে ১৪টি এফডিআর হিসাবে মোট ৮ কোটি টাকা নগদ জমা করেছেন। এর বাইরে যমুনা ব্যাংকে ৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৭ টাকা জমার তথ্য পাওয়া যায়। এ দুটি ছাড়াও আরও বিভিন্ন হিসাবে লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। যার কোনো গ্রহণযোগ্য বক্তব্য, ব্যাখ্যা, তথ্য-প্রমাণ তিনি উপস্থাপন করতে পারেননি। দুদক জানায়, একজন সরকারি কর্মচারীর নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে মাত্র এক বছরে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ নগদ জমা হওয়ার বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় এটি ঘুষ, দুর্নীতি ও অবৈধ উৎস গোপন করতে নগদে এফডিআর করে মানি লন্ডারিং করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুদক আরও জানায়, নজরুলের স্ত্রী সৈয়দা তামান্না রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় ১৮১৪ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ২০০ টাকা ও নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় ২ কাঠা ৮ ছটাকের প্লট ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা মোট ১৬ লাখ ৪৯ হাজার ২০০ টাকার স্থাবর সম্পদের হিসাব দিয়েছেন। অন্যদিকে অস্থাবর হিসেবে তার নামে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের ধানমন্ডি শাখায় ২০০১ সালের ২৩ জুন একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলা হয়। অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই হিসাবে ৮২ লাখ ৫৬৩/৩২ টাকা জমা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে তামান্নার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ হিসেবে মোট ১৭ লাখ ৩১ হাজার ৭৬৩/৩২ টাকার তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তামান্না গৃহিণী এবং তার নামে আয়কর নথিতে এসব সম্পদের তথ্য থাকলেও মূলত স্বামীর অবৈধ আয়কে বৈধ করতে প্রতারণার হিসেবে আয়কর নথি খুলেছেন। কেননা আয়কর নথিতে মৎস্য ব্যবসার কথা বলা হলেও কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। এ ছাড়া তামান্নার আয়কর নথিতে ভুয়া আয় দেখিয়ে স্বামীকে দেওয়া ৬ কোটি দানের টাকাকে (অবৈধ পন্থায় অর্জিত) বৈধতা দিতে সহযোগিতা করেছেন। অর্থাৎ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মূল্য হিসেবে ১৭ লাখ ৩১ হাজার ৭৬৩/৩২ টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭ (১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অন্যদিকে নজরুলের ভাই সৈয়দ হাসান শিবলীর নামে ইস্টার্ন ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা ও ধানমন্ডি শাখায় দুটি হিসাব পরিচালিত হয়। প্রিন্সিপাল শাখার হিসাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১১ সালের ২ অক্টোবর খোলা হয়। ২০১৮ সালের ২ জুলাই প্রথম ৫০ হাজার টাকা জমার মাধ্যমে লেনদেন শুরু করা হয়। ২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত হিসাবটিতে ৮ কোটি ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ৮৪৯/৭১ টাকার বিপরীতে ৭ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার ৭২৭/৪৭ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। যেখান থেকে তার ভাই নজরুলের ঋণ হিসেবে ৩৪ লাখ ৩২ হাজার ৬৩৬/৬৬ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় এই টাকা পরিশোধে অনাপত্তির বিষয় দেখা গেছে। এ ছাড়া হাসান শিবলীর হিসাবে তার ভাই নজরুল ইসলামের অগ্রণী ব্যাংকের হিসাব থেকে বিভিন্ন চেকের মাধ্যমে ২০ লাখ ও তার স্ত্রী তামান্নার স্ট্যান্ডার্ড চ্যাটার্ড ব্যাংকের হিসাব থেকে বিভিন্ন চেকে ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা করা হয়েছে। দুদক জানায়, ২০১৩ সালের ৩ অক্টোবর থেকে ২০১৮ সালের ২৪ জুন পর্যন্ত মোট ২৮ লাখ টাকা সৈয়দ হাসান শিবলীর হিসাবে জমা করা হয়। যা পরবর্তীতে সৈয়দ হাসান শিবলীর নিজস্ব চেক/মো. নজরুল ইসলামের নামে প্রদত্ত চেক দ্বারা উত্তোলন করা হয়েছে। সৈয়দ হাসান শিবলীর ২টি হিসাবে বর্তমানে ৪০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৩৬ টাকা জমা আছে। নামীয় উক্ত ২টি ব্যাংক হিসাব খুলে মো. নজরুল ইসলামকে ব্যাংক হিসাব পরিচালনার ক্ষমতাপত্র দিয়েছেন। অর্থাৎ সৈয়দ হাসান শিবলীর যোগসাজশে মো. নজরুল ইসলামের ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ আয়কে বৈধ করার সুযোগ করে দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। প্রিন্সিপাল শাখার বাইরে ইস্টার্ন ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখার হিসাবটি ২০১১ সালের ২ অক্টোবর খোলা হয়। হিসাবটিতে খোলার তারিখ থেকে ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ১৩ কোটি ১৫ লাখ ৫২ হাজার ৪৮৩/০৭ টাকার বিপরীতে ১২ কোটি ৯৭ লাখ ৩৪ হাজার ৯৬৭/০৮ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। হিসাবটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, নজরুল ইসলামের স্ট্যান্ডার্ড চ্যাটার্ড ব্যাংক এবং তার স্ত্রীর অগ্রণী ব্যাংকের হিসাব থেকে বিভিন্ন চেকে মোট ২৮ লাখ টাকা হাসান শিবলীর হিসাবে জমা করা হয়, যা পরবর্তীতে শিবলীর নিজস্ব চেক বা নজরুল ইসলামের নামে দেওয়া চেক দ্বারা উত্তোলন করা হয়েছে। তার হিসাবে বর্তমানে ৪০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৩৬ টাকা জমা আছে। হাসান শিবলী দুটি ব্যাংক হিসাব খুলে তার ভাই নজরুল ইসলামকে ব্যাংক হিসাব পরিচালনার ক্ষমতাপত্র দিয়েছেন। অর্থাৎ শিবলী যোগসাজশে নজরুলকে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ আয়কে বৈধ করার সুযোগ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। দুদক জানায়, সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করে নজরুল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে মানি লন্ডারিং, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৬ কোটি ১৭ লাখ ৩১ হাজার ৭৬৩ টাকার সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া নজরুল ইসলামের অবৈধ আয়কে বৈধতা দিতে হাসান শিবলী নিজের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তাকে মানি লন্ডারিংয়ে সহায়তা করেছেন। প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১); মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারায় ১টি মামলা করা হয়েছে। বিষয়টি এখন কমিশন তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
Link copied!