বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বপ্নের মেট্রো যাত্রা শুরু হয়ে গেল

প্রকাশিত: ১০:৩০ এএম, ডিসেম্বর ২৮, ২০২২

স্বপ্নের মেট্রো যাত্রা শুরু হয়ে গেল

ডেইলি খবর ডেস্ক: স্বপ্নের মেট্রো যাত্রা শুরু হলো রাজধানী ঢাকায়।এমআরটি-৬ কমলাপুর পর্যন্ত পুরোদমে চালু হলে এটি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিববহন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।কোভিডের প্রাদুর্ভাব না হলে ঢাকা মেট্রো হতো এশিয়ার দ্রæত সম্পন্ন হওয়া মেট্রো প্রকল্পগুলোর একটি। গত বছরের বিজয় দিবসে উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল ঢাকা মেট্রোর। অবশেষে স্বাধীনতা লাভের ৫১ বছর পর বাংলাদেশ পেতে যাচ্ছে প্রথম মেট্রোরেল। আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার প্রতীক এই মেট্রোরেল পাওয়ার ইচ্ছা আছে অনেক শহরেরই, কিন্তু পেয়েছে খুব কম শহরই। বাংলাদেশ অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় দেশ হিসেবে মেট্রোরেল সেবার স্বাদ পেতে যাচ্ছে। ভারতের তুলনায় একটু দেরিতেই এই ব্যয়বহুল ও জটিল উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে। ভারতের প্রথম মেট্রোরেল সেবা চালু হয় কলকাতায়, ১৯৮৪ সালে। পাকিস্তানের প্রথম মেট্রো চালু হয়েছে মাত্র দু-বছর আগে, লাহোরে। দেশের গর্ব পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ছয় মাস পর আংশিকভাবে চালু হচ্ছে হচ্ছে মেট্রো, যা এলিভেটেড মেট্রো রেলওয়ে নামেও পরিচিত। এটিই হবে দেশের প্রথম বিদ্যুৎচালিত, পরিবেশবান্ধব রেল। ২৮ ডিসেম্বর সকালে উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে মেট্রোরেল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।প্রথমে যাত্রী নিয়ে চালু হবে শুধু মেট্রোরেলের উত্তরা-আগারগাঁওয়ের ১১ কিলোমিটার অংশে, যা এমআরটি-৬-এর অংশ। মোট ছয়টি রুটে রাজধানী ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় চলবে মেট্রোরেল। এর কাজ পুরোটা সম্পন্ন হওয়ার পর মেট্রো-৬-কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হবে। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল রুটের কাজ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এবং মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত অংশ ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।প্রায় ১২৯ কিলোমিটারের ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) নেটওয়ার্ক—যার ৬১ কিলোমিটার হবে মাটির নিচে—ঢাকার কুখ্যাত যানজটে নিয়মিত আটকা পড়া শহরের যাত্রীদের স্বস্তি দেবে। যানজটের কারণে ঢাকার যানবাহনের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ৪.৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ ঢাকা শহরের রাস্তায় যানবাহনের গড় গতিবেগ হাঁটার গতিবেগের চেয়েও কম। যদিও সরকার গত এক দশকে সড়ক অবকাঠামোর পেছনে ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে।১২ বছর আগে রাজধানীতে মোটরগাড়ির গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। দুই বছর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ চলতি দশকে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো চলমান নগর পরিবহন অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর সুফল পেতে শুরু করবে।বহুল প্রত্যাশিত ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা ব্যয়ের মেট্রোরেল হবে একটি সমন্বিত নগর পরিবহন নেটওয়ার্কের সূচনা। ১৬০ বছর আগে পাতালরেল হিসেবে মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু। তবে এখন এটি বিশ্বের ১৯০টির বেশি শহরজুড়ে পাতাল ও উড়াল—উভয় পথেই চলে। সাবওয়ে, টিউব, লাইট ট্রেন, আন্ডারগ্রাউন্ড কিংবা শুধু মেট্রো—যে নামেই ডাকা হোক না কেন, পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোর যাত্রীরা মেট্রোরেল ব্যবস্থা থেকে সুফল পাচ্ছে। মেট্রো মানুষের সময় বাঁচিয়ে দিচ্ছে বিপুলভাবে। মেট্রো না থাকলে কর্মদিবসে তাদেরকে রাস্তাতেই কাটিয়ে দিতে হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অন্যতম দ্রæততম, ঝামেলামুক্ত এবং সবুজ পরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে মেট্রোরেল ব্যবস্থা সর্বত্রই সমাদৃত। এ কারণেই আরও অনেক শহর তাদের ম্যাস র‌্যাপিড আরবান ট্রানজিট সার্ভিসের অংশ হিসেবে মেট্রোরেল চালু করার পরিকল্পনা করছে। প্রথম মেট্রোরেল চালু হওয়ার প্রায় চার দশক পর ভারতে এখন ১৫টি শহরে মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক রয়েছে, যেখানে দিল্লি মেট্রো বিশ্বের সেরা মেট্রো সেবাগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। মেট্রো পাওয়া ভারতের প্রথম শহর কলকাতা এখন আগামী বছর নদীর ওপর দিয়ে মেট্রোরেলের চালু হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। নদীর ওপর দিয়ে যাওয়া এমন একটি মেট্রোরেল হচ্ছে লন্ডন ও প্যারিসকে যুক্ত করা ইউরোস্টার।এদিকে পাকিস্তানের লাহোরে ২০২০ সালে দেশটির প্রথম ও একমাত্র মেট্রোরেল চালু হয়েছে। লাহোর মেট্রো নামে পরিচিত ২৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের অরেঞ্জ লাইন-এ ২৬টি স্টেশন রয়েছে। এই পথে প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ যাতায়াত করে।সিস্টেমটি পুরোদমে চালু হলে দৈনিক যাতায়াতকারীর সংখ্যা আড়াই লাখে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।চীন-নির্মিত এই চালকবিহীন আধুনিক পরিবহন সেবা লাহোরে ভ্রমণের সময় ব্যাপকভাবে কমিয়ে এনেছে। বাসে চেপে আড়াই ঘণ্টায় যে দূরত্ব পাড়ি দেওয়া যায়, সেই একই দূরত্ব মেট্রোতে পাড়ি দিতে সময় লাগে মাত্র ৪৫ মিনিট।বছরের পর বছর বিলম্ব এবং রাজনৈতিক বিতর্কের পর অবশেষে চালু হওয়া পাকিস্তানের ১.৮ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পটি থেকে এখন কারা সবচেযে বেশি উপকৃত হচ্ছে? মেট্রো সেবা থেকে কারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে?লাহোরে মেট্রোরেলের সুফল সবচেয়ে বেশি পাচ্ছে মধ্যবিত্তরা। ঢাকার অনেক মানুষই মনে করছেন, আপাতদৃষ্টে চড়া ভাড়ার কারণে সাধারণ যাত্রীরা মেট্রো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, এ থেকে লাভবান হবে শুধু গাড়ির মালিক কিংবা উবার বা সিএনজিচালিত অটোতে চড়ার সামর্থ্য রাখা মানুষেরা। কিন্তু লাহোরের চিত্র তাদের এ ধারণার একেবারেই বিপরীত।মেট্রো চালু হওয়ার এক বছর পর পাকিস্তানি মিডিয়া লাহোরের একজন কর্মজীবী নারীর উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ওই নারীর যাতাযাত খরচ কমে এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। আগে যাতায়াতের পেছনে তার মাসেখরচ হতো ৩৫ হাজার রুপি, এখন খরচ হয় ১০ হাজার রুপি। যদিও তাকে প্রতিদিন মেট্রোতে একাধিকবার যাতায়াত করতে হয়।মেহক ইদ্রিস নামের ওই নারী হাসিমুখে জানিয়েছেন মেট্রো ট্রিপ তাকে কীভাবে সময়মতো অফিসে পৌঁছাতে এবং বাচ্চাদের আগে আগে বাড়ি ফিরতে এবং তার যাত্রাকে ঝামেলামুক্ত করতে সাহায্য করছে। হান্নাননামের একজন স্কুলছাত্র বলেছেন, মেট্রো তার যাতায়াতের সময় বাঁচিয়ে দিয়েছে এবং তার স্কুলে যাতায়াতও ঝামেলামুক্ত করেছে। এর ফলে তিনি সকালে বেশি সময় ঘুমাতে পারেন।এমআরটি-৬ কমলাপুর পর্যন্ত পুরোদমে চালু হলে এটি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিববহন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এবং এই যাত্রীদের মধ্যে কর্মজীবী নারী, শিক্ষার্থী, অফিসগামী, ব্যবসাযী ও নির্বাহীরা থাকবেন।এসি বগিতে ২০ মিনিটে ১১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য ৫০ টাকা ভাড়াকে যদি বাসের ভাড়ার চেয়ে বেশি মনেও হয়, তারপরও এই ভাড়া উবারে চলাচলে খরচের দশ ভাগের এক ভাগ এবং সিএনজি অটোরিকশায় চলাচলের খরচের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। আর ঢাকার বাসে ওঠার এবং রোদ, বৃষ্টি ও ঠান্ডায রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানোর বিপদের কথা নাহয় তোলাই থাকল। দিল্লি, কলকাতা, লাহোরের পরে হলেও ঢাকার যাত্রীরা একটি আধুনিক পরিচ্ছন্ন পরিবহন ব্যবস্থার সুবিধা পাচ্ছেন। অবশ্য ঢাকার যাত্রীরা হো চি মিন সিটি এবং কলম্বোর আগেই মেট্রোরেলে চড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। যদিও ওই দুটি শহরের মেট্রোর কাজও জাইকার অর্থায়নে ঢাকার আগেই শুরু হয়েছিল।সুত্র-টিবিএস  
Link copied!