শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বর্ণচোরাকারবারীর স্বর্ণবারে সোনালি জীবন!

প্রকাশিত: ১০:০৭ এএম, মার্চ ১৮, ২০২২

স্বর্ণচোরাকারবারীর স্বর্ণবারে সোনালি জীবন!

ডেইলি খবর ডেস্ক: স্বর্ণচোরাকারবারীর স্বর্ণবারে সোনালি জীবন আবুর! ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২০১৪ সালে পরপর দুই হাজার ২৫টি স্বর্ণবার আটকের ঘটনায় নাম আসে চট্টগ্রামের আবু আহমেদের। বিমানবন্দর থানা ও পল্টন থানায় তাকে আসামি করে চোরাচালান মামলা হয়। এরপর ২০১৬ সালে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে আবুর গুদাম থেকে ২৫০টি স্বর্ণবার এবং নগদ ৬০ লাখ টাকা জব্দ করে পুলিশ। সে ঘটনায় করা মামলার আসামিও আবু। চট্টগ্রামে স্বর্ণবার নিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়া অনেক আসামির জবানবন্দিতেও উঠে আসে আবুর নাম।পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে,আবু আহমেদ আন্তর্জাতিক স্বর্ণবার চোরাচালানের অন্যতম হোতা। তার গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ির জাফতনগরে স্বর্ণ চোরাচালান মামলার আসামি রয়েছেন ২১ জন। তারা সবাই প্রবাসী এবং আবুর সঙ্গে যুক্ত।অনুসন্ধানে দেখা গেছে,গত ১২ বছরে চট্টগ্রামে ২১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৭২১ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন আবু আহমেদ।এই লেনদেনগুলো যাদের সঙ্গে হয়েছে,তাদের অধিকাংশেরই নাম রয়েছে চোরাচালানকারীদের তালিকায়। আবু আহমেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিয়ে অনুসন্ধান করেছে সিআইডিও। একজন কর্মকর্তা জানান, এই ৭২১ কোটি টাকা স্বর্ণ চোরাচালানেই লেনদেন হয়েছে। স্বর্ণ চোরাচালানের অর্থ দিয়ে আবু দুবাই, চট্টগ্রাম ও ফটিকছড়িতে গড়ে তুলেছেন বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমিসহ সম্পদের পাহাড়। এক যুগে আবুর ২৫০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। পাঁচ ব্যাংকে আবুর নিজের নামে থাকা ছয়টি এবং সাতটি প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ১৫টি ব্যাংক হিসাবে এ অর্থ লেনদেন হয়।এ প্রসঙ্গে অর্থ পাচার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম শাখার পরিদর্শক ছাদেক আলী বলেন, তদন্ত শেষে আবুর সহযোগী ২১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। কয়েকশ কোটি টাকা তারা বিদেশে পাচার করেছেন। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। স্বর্ণবার চোরাচালানের মাধ্যমে অর্জিত ৭২১ কোটি ১৭ লাখ ৩৯ হাজার টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করার প্রমাণ চার্জশিটে তুলে ধরা হয়েছে।তবে আবু আহমেদ দাবি করেন, আমি ব্যবসা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছি। আমি স্বর্ণবার চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত নই। সিআইডি যে চার্জশিট দিয়েছে, তা আইনিভাবে মোকাবিলা করা হবে।অর্থ পাচার মামলায় আসামি ২১ জন। এর মধ্যে আটজন পলাতক, চারজন কারাগারে ও ৯ জন জামিনে রয়েছেন। আবুর ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে এখন স্থিতি রয়েছে এক কোটি ২৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮২৮ টাকা। বাকি টাকা উত্তোলন করেছেন। অভিযোগপত্রের তথ্যমতে,আবুর সহযোগী ইকবাল আহমেদ ওরফে নিজামের চারটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক যুগে হুন্ডির মাধ্যমে জমা হয়েছে ৫২ কোটি ৪৯ লাখ ৫৭ হাজার ২০৭ টাকা। ফটিকছড়ির জাফতনগরের নুর মোহাম্মদের ছেলে আবু রাশেদের একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে এক কোটি ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। হুন্ডির মাধ্যমে রাশেদ বিদেশে পাচার করেছেন ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। একইভাবে চোরাচালান চক্রের সদস্য ইমরানুল হক মো. কফিল চৌধুরীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দুই কোটি ২০ লাখ ৯০ হাজার টাকা, এমতিয়াজ হোসেনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তিন কোটি ১৫ লাখ টাকাসহ সিন্ডিকেটের প্রত্যেক সদস্যের অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়। ২১ অ্যাকাউন্ট :মোবাইল ফোন, কসমেটিকস,বডি স্প্রে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর আড়ালে আবু আহমেদ ও তার সিন্ডিকেট ২১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১২ বছরে ৭২১ কোটি টাকা লেনদেন করেছে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক নগরীর স্টেশন রোড শাখায় সাতটি অ্যাকাউন্ট, সিটি ব্যাংক জুবলী রোড শাখায় তিনটি অ্যাকাউন্ট, যমুনা ব্যাংক জুবলী রোড শাখায় তিনটি অ্যাকাউন্ট, ব্র্যাক ব্যাংক নিউমার্কেট শাখায় সাতটি অ্যাকাউন্ট এবং ইস্টার্ন ব্যাংক নিউমার্কেট শাখায় একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। ২০০৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে আবু ও তার সহযোগীরা এ ব্যাংক হিসাবগুলোতে লেনদেন করেন। দুবাইয়ে দোকান :দুবাইয়ে আবু আহমেদের নামে তিনটি দোকান এবং একটি ফ্ল্যাটের হদিস পেয়েছে সিআইডি। এ ছাড়া আবু ফটিকছড়ির ধর্মপুর ও জাহানপুর এলাকায় ২৪টি দলিলমূলে কয়েক একর জমি কিনেছেন। চট্টগ্রাম নগরীর কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকার ৩৩ নম্বর প্লটে ১৬ কাঠার প্লট ছাড়াও পাঁচলাইশ হিলভিউ আবাসিক এলাকার পাঁচতলা নিরিবিলি ভবন এবং চান্দগাঁওয়ে ছয়তলা বাড়ি রয়েছে তার। চট্টগ্রামের স্যানমার, রিয়াজউদ্দিন বাজারে রয়েছে একাধিক দোকান। রাউজানের ফতেহনগর এলাকায় পল্লী কানন ও পল্লী শোভা কনভেনশন হল, ফটিকছড়ির ফতেহপুরে দৃষ্টিনন্দন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তিনতলা বাড়ি জাহানারা ম্যানশন, চট্টগ্রাম নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারে দুটি, স্যানমার ওশান সিটিতে একটি দোকান রয়েছে তার।আবুর গ্রামে চক্র :ফটিকছড়ির জাফতনগর ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামে বাড়ি আবু আহমেদের। তার বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় চট্টগ্রাম-ঢাকায় পাঁচটি স্বর্ণ চোরাচালান, মানি লন্ডারিং, প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলার রেকর্ড রয়েছে। জেলও খেটেছেন তিনি। আবুর ম্যানেজার এনামুল হক নাঈমও একই গ্রামের বাসিন্দা। স্বর্ণ চোরাচালানের একটি মামলায় সাত বছর সাজাপ্রাপ্ত হন নাঈম। এখন পলাতক। তার মাথার ওপর ঝুলছে আরও তিনটি স্বর্ণবার চোরাচালান মামলা। অনুসন্ধানে জানা যায়, নাঈম তার আপন ভাই নেজাম উদ্দিনকেও অপরাধ জগতে নিয়ে এসেছেন। চোরাচালান মামলায় নেজামও কারাভোগ করেছেন। আবুর গ্রামের স্বর্ণবার চোরাচালান মামলার অভিযুক্তরা হলেন- ফতেহপুর গ্রামের কোরবান আলী পন্ডিত বাড়ির সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বাচ্চু ও মোহাম্মদ আলী,সারেং বাড়ির খোরশেদ আলম রুবেল, শামসুল হকের ছেলে হেলাল উদ্দিন, ইকবাল মোহাম্মদ নেজাম ও মো. রফিক, জাহানপুর গ্রামের বাসিন্দা জিয়া উদ্দিন বাবলু, আবু রাশেদ, মাহবুবুল আলম আলমগীর, ইমরান আহমেদ মির্জা ওরফে সবুজ, জসিম, জাফর, রহিম, রনি, ইমরান, ইব্রাহিম, মুক্তার, হাকিম ও সাত্তার। এরা সবাই ব্যক্তিগত পাসপোর্ট ব্যবহার করে কেউ অর্ধ ডজন, কেউ এক ডজনের বেশিবার দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যে আসা-যাওয়া করেছেন। ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এই চক্রের ২২ জনের বিরুদ্ধে ৩২টি চোরাচালান হয়েছে চট্টগ্রামে।ফটিকছড়ির জাফতনগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হালিম জানান, আবু আহমেদ স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বলে শুনেছি। মিডিয়ায় অনেকবার নামও দেখেছি। দুবাইয়ে আবুর আন্ডারে চাকরি করতে গিয়ে এলাকার অনেকে চোরাচালান মামলায় ফেঁসে গেছেন বলে অভিযোগ আছে। তার বাবা ফয়েজ আহমেদ তকিরহাট বাজারে একজন মুদি দোকানদার ছিলেন। তিনি প্রবাসী শ্রমিক ছিলেন। আবু এখন অনেক টাকার মালিক কীভাবে হয়েছেন-তা রহস্যজনক।সিআইডি সূত্র জানায়, ১৯৯১ সালে আবু আহমেদ প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে দুবাই কাজ করতে যান। দুবাই গিয়েই তিনি অল্প কিছু দিনের মধ্যে জড়িয়ে পড়েন স্বর্ণবার চোরাচালানে। এখন তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক। ফটিকছড়ির গ্রামে গেলে থাকেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দৃষ্টিনন্দন 'জাহানারা ভবন' নামে তিনতলা আলিশান বাড়িতে।সুত্র-সমকাল
Link copied!