বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

হঠাৎ করেই বাংলাদেশ যেন তেলের ‘খনি’

প্রকাশিত: ১২:১৪ পিএম, মে ১১, ২০২২

হঠাৎ করেই বাংলাদেশ যেন তেলের ‘খনি’

সয়াবিন তেল এবং পাম অয়েল কোনো খনিজ পদার্থ নয়। একটি উৎপাদন হয় কৃষিজমিতে, আরেকটি গাছে। কিন্তু হঠাৎ করেই পুরো বাংলাদেশ যেন সয়াবিন তেলের ‘খনি’তে পরিণত হয়েছে। কখনও সয়াবিন তেলের ‘খনি’র সন্ধান মিলছে ঘরের বাঙ্কারে আবার কখনও গোডাউনের ভেতরে। আর দেশকে সয়াবিন তেলের খনিতে পরিণত করেছে অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা। আগের কম দামে তেল কিনে নতুন বাড়তি দামে বিক্রি করতে সারা দেশে তারা লুকিয়ে রেখেছিল সয়াবিন তেল। সেগুলোরই এখন সন্ধান মিলছে এক এক করে। কোনো জেলায় ১ লাখ লিটারের বেশি, কোথাও ৭৭ হাজার লিটার, কোনো জেলায় ৫৭ হাজার লিটার আবার কোথাও ৪০ হাজার লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার হচ্ছে। এ অবস্থা দেখে বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীরা অসাধুতার নিকৃষ্টতম নজির স্থাপন করল। ভোজ্য তেল গায়েব করে দিয়ে এভাবে দেশের মানুষের টাকা লুটপাট করা তাদের মোটেই সমীচীন হয়নি। এ বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘ব্যবসায় মুনাফা করতে হবে ঠিক আছে, তাই বলে মুনাফার নামে এভাবে তেল জিম্মি করে মানুষের অর্থ লুটপাট করবে তারা এটি মেনে নেওয়া যায় না। আসলে ব্যবসায়ীদের উচিত ছিল এই সঙ্কটকালে কীভাবে একটু কম দামে তেল বিক্রি করে দেশের মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া যায়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা তা না যেভাবে সঙ্কট সৃষ্টি করেছে তাতে তাদের ব্যবসায়ী না বলে মুনাফাখোর ও অর্থলোপাটকারী হিসেবে অখ্যায়িত করা উচিত।’ গত প্রায় ৬ মাস ধরে দেশের ভোজ্য তেলের বাজার টালমাটাল অবস্থা। বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে তেলের বাজারে সঙ্কট আরও বেশি হয় গত রোজার আগ থেকে। আর ঈদের আগের এক সপ্তাহ ও পরের এক সপ্তাহে দেশ থেকে ভোজ্য তেল একরকম গায়েব করে দিয়ে ব্যবসায়ীরা তেলের বাজারের সঙ্কটকে আরও চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। ঈদের আগেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয় ঈদের পর ৫ মে তেলের দাম পুনঃ নির্ধারণ করা হবে। মূলত এ খবরেই ভোজ্য তেলের মিলমালিক, ডিলার, পাইকারি এবং খুচরা- সব পর্যায়ের ব্যবসায়ী তেল লুকিয়ে ফেলে। এতে দেশের বাজার একেবারে তেলশূন্য হয়ে পড়লে তেলের জন্য বাজারে হাহাকার পড়ে যায়। ফলে নড়েচড়ে বসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিদফতর। রোববার থেকে একযোগে রাজধানী ঢাকাসহ ৬৪ জেলায় তেলের সন্ধানে অভিযানে নামে ভোক্তা অধিদফতর। অভিযানে নামা প্রথম দিন থেকেই বের হতে শুরু করে তেলের খনি। রবি থেকে গতকাল মঙ্গলবার- এই তিন দিনে দেশের বেশ কয়েকটি জেলা মিলে মোট ৩ লাখ ৭১ হাজার ১৩৮ লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করেছে ভোক্তা অধিদফতরের টিম। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সয়াবিন তেল উদ্ধার হয়েছে রাজশাহী জেলায়। জেলার বাঘা উপজেলায় সোমবার উদ্ধার হয় ২৬ হাজার ৭২৪ লিটার সয়াবিন তেল। আর গতকাল রাজশাহীর বানেশ্বর এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় ৯২ হাজার ৬১৬ লিটার সয়াবিন তেল। সব মিলিয়ে রাজশাহী জেলাতেই উদ্ধার করা হলো ১ লাখ ১৮ হাজার ৬১৬ লিটার তেল। এ ছাড়া চট্টগ্রাম জেলায় তিন দিনে উদ্ধার হয়েছে ৭৫ হাজার ৩৭৮ লিটার, খাগড়াছড়িতে ৫৭ হাজার লিটার, কুষ্টিয়ায় ৪০ হাজার লিটার, ঢাকায় ৩০ হাজার লিটার, পাবনায় ১৮ হাজার ২৪৪ লিটার, গোপালগঞ্জে ১২ হাজার লিটার, গাজীপুরে ৭ হাজার ১৫৮ লিটার, সিরাজগঞ্জে ৬ হাজার লিটার, সিলেটে ৫ হাজার লিটার এবং দিনাজপুরে ১ হাজার লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করা হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত। ভোক্তা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এ অভিযান এখনও চলবে। সুতরাং আগামী দিনগুলোতে অন্য জেলায়ও তেলের সন্ধান মিলবে- এটা নিশ্চিত। এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা যেভাবে সয়াবিন তেল লুকিয়ে রেখেছে তা দেখে আমরা হতবাক হয়ে গেছি। কতটা অসৎ হলে ব্যবসায়ীরা এ ধরনের কাজ করতে পারে। সুতরাং আমরা এই অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে সার্বাত্মক চেষ্টা চালাব। আমরা অভিযান আরও জোরদার করব। এক্ষেত্রে তাদের কোনো রকম ছাড় দেব না।’ কোন জেলায় কত তেল উদ্ধার হলো : গত তিন দিনে কোন জেলায় কি পরিমাণ সয়াবিন তেল উদ্ধার হলো তার চিত্র পাওয়া যায় প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে- রাজশাহী : মঙ্গলবার জেলার পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর বাজারের চারটি গুদামে অভিযান চালিয়ে ৯২ হাজার ৬১৬ লিটার সয়াবিন ও পাম তেল জব্দ করেছে পুলিশ। এ সময় অবৈধভাবে ভোজ্য তেল মজুদ করায় চারজনকে আটক করা হয়েছে। এর আগে সয়াবিন তেল মজুদ ও বেশি দামে বিক্রি করার অভিযোগে নগরীর তিনটি দোকানকে ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর। এ ছাড়া এক দিন আগে সোমবার সন্ধ্যায় বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর বাজার থেকে অবৈধভাবে মজুদ করা ২৬ হাজার ৭২৪ লিটার সয়াবিন ও সরিষার তেল জব্দ করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় এক ব্যবসায়ীকে আটক করে তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম : গত শুক্র থেকে সোমবার পর্যন্ত চট্টগ্রামে ব্যবসায়ীদের গুদাম থেকে ৭৫ হাজার ৩৭৮ লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করা হয়েছে। ভোক্তা অধিকার অধিদফতর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ফয়েজউল্যাহ বলেন, রমজানের আগে কেনা এসব তেল দোকান মালিক সিরাজ সওদাগর গুদামে রেখে দিয়েছিল; কিন্তু দোকানে তেল ছিল না। সে মোট ১ হাজার ৫০ কার্টনে অন্তত ১৫ হাজার লিটার তেল গুদামে রেখেছিল। এর আগে রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগরীর সিডিএ কর্ণফুলী মার্কেটে অভিযান চালিয়ে একটি গুদাম থেকে ১ হাজার ৫০ লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করেছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর। এই তেলও রমজানের আগে অবৈধভাবে মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে খাজা স্টোর নামে ওই দোকানের মালিক। তাকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়ির এক ব্যবসায়ীর গুদাম থেকে ৫৭ হাজার লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করা হয়। অবৈধভাবে তেল মজুদের দায়ে খাগড়াছড়ির রামগড় পৌরসভার সোনাইপুল বাজারের ব্যবসায়ী ফজলুর করিম পাটোয়ারীকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে রামগড় পৌরসভার সোনাইপুল বাজারে এ অভিযান চালানো হয়। অবৈধভাবে তেল মজুদের দায়ে ওই বাজারের ব্যবসায়ী ফজলুর করিম পাটোয়ারীকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া তেল মজুদ করায় একই বাজারের মেসার্স আলমগীর স্টোরকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ঢাকা : রাজধানী ঢাকার ডেমরা এলাকায় তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ৩০ হাজার লিটার খোলা পাম ও সয়াবিন তেল উদ্ধার করা হয়েছে। একই সঙ্গে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রির অপরাধে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সোমবার রাজধানীর ডেমরা রোডের কাজলা ব্রিজ এলাকায় ভোক্তা অধিদফতর ও র‌্যাব-৩-এর যৌথ অভিযানে এই তেল উদ্ধার ও জরিমানা করা হয়। ভোক্তা অধিদফতরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিসপ্রধান মো. আব্দুল জব্বার মণ্ডল এবং ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. মাগফুর রহমান এ অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানের পর অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, কাজলা ব্রিজ এলাকার মেসার্স অদিতি ট্রেডিং, মেসার্স সিফাত ট্রেডিং ও মেসার্স মিন্টু স্টোর থেকে পুরনো দামের ২৯ হাজার ৫৮০ লিটার খোলা পাম ও সয়াবিন তেল দোকানে লুকিয়ে রেখেছিল। অভিযানে এসব তেল উদ্ধার করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো আগের ১৪৩ টাকা দামের সয়াবিন ১৮৩ থেকে ১৮৪ টাকায় বিক্রি করছে। এ ছাড়াও তাদের কাছে ক্রয়-বিক্রয়ের কোনো পাকা রসিদ পাওয়া যায়নি। এসব অপরাধে ৫০ হাজার টাকা করে তিন প্রতিষ্ঠানকে মোট ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে উদ্ধার করা এসব তেল সরকারের আগের দামে বিক্রির নির্দেশ দেওয়া হয়। গাজীপুর : গাজীপুরে ৭১৫৮ লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করা হয়েছে এবং ৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের জব্দ করা তেলের মধ্যে ২ হাজার ৫৮ লিটার প্যাকেটজাত তেল বসুন্ধরা ও সান কোম্পানির মেসার্স মনির জেনারেল স্টোরের গোডাউন থেকে এবং ৫ হাজার ১০০ লিটার খোলা তেল আরপি ট্রেডার্সের গোডাউন থেকে জব্দ করা হয়। এ সময় মেসার্স মনির জেনারেল স্টোরের গোডাউন মালিকের কাছ থেকে ২ লাখ এবং আরপি ট্রেডার্সের মালিকের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। গোপালগঞ্জ : গোপালগঞ্জে প্রায় ১২ হাজার লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করা হয়েছে এবং ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সোমবার জেলা শহরের বড়বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই জরিমানা করেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শামীম হাসান। সিলেট : মঙ্গলবার ভোক্তা অধিকারের সিলেট জেলা কার্যালয় পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত নগরীর পাইকারি বাজার কালীঘাটে অভিযান চালান। অভিযানকালে কালীঘাটের মাহের ব্রাদার্স নামে একটি দোকানের গুদাম থেকে প্রায় ৫ হাজার লিটার মজুদ করা সয়াবিন তেল জব্দ করা হয়। পরে সেই ৫ হাজার লিটার সয়াবিন আগের দামে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় মাহের ব্রাদার্সকে জরিমানাও করা হয়। পাবনা : পাবনা ঈশ্বরদীর মুদিদোকানের গোডাউন থেকে ১৮ হাজার লিটার তেল জব্দ করা হয়েছে। মুদি দোকানের গুদামে অভিযান চালিয়ে ১৮ হাজার ২৪৪ লিটার ভোজ্য তেল উদ্ধার করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে উপজেলা সদরের ‘শ্যামল স্টোর’ নামে একটি দোকানের গুদামে অভিযান চালায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। এ ঘটনায় ওই দোকানের মালিক শ্যামল দত্তকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া সোমবার কুষ্টিয়া পৌর বাজার থেকে ৪০ হাজার লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করা হয় এবং তিন প্রতিষ্ঠানকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তা ছাড়া সিরাজগঞ্জে ৬ হাজার লিটার ও দিনাজপুরে ১ হাজার লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করা হয়।
Link copied!