বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

১৭ কোটি ভোক্তার ভার ১০১ কর্মকর্তার ওপর!

প্রকাশিত: ১০:৫৭ এএম, নভেম্বর ২৮, ২০২১

১৭ কোটি ভোক্তার ভার ১০১ কর্মকর্তার ওপর!

দেশের প্রত্যেক মানুষ কোনো না কোনো পণ্যের ভোক্তা। সে অর্থে প্রায় ১৭ কোটি মানুষই ভোক্তা। ভোক্তার অধিকার রক্ষায় একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার নাম ‘জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর’। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকসহ মাত্র ১০১ কর্মকর্তার কাঁধে রয়েছে এই ১৭ কোটি ভোক্তার ভার। সে হিসাবে ১৭ লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন কর্মকর্তা। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য স্বল্পসংখ্যক কর্মকর্তা হওয়ায় ভোক্তার অধিকার সুরক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য অধিদফতর থেকে জনবল বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে বাজার অভিযান থেকে শুরু করে অধিদফতরের প্রাত্যহিক কাজে চরম ব্যাঘাত ঘটছে। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণা ও ক্রেতা ঠকানোর কারণে ভোক্তা অধিদফতরের কাজের পরিধি আরও বেড়েছে। এখন অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে অনলাইনে পণ্য কিনে প্রতারিত হওয়া ক্রেতার অভিযোগ নেওয়া ও নিষ্পত্তিতে। কারণ ই-কমার্সের ভোক্তার অভিযোগই আসছে সবচেয়ে বেশি। এই কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে ভোগ্যপণ্যের বাজার ও কারখানা পর্যায়ে নিয়মিত অভিযান কার্যক্রমও চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে একদিকে বাজারে ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য বাড়ছে, অন্যদিকে ভোক্তার নানাভাবে প্রতারিত হওয়ার হার বাড়ছে। ভোক্তা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে মহাপরিচালকসহ প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা রয়েছেন ১৩ জন। এর মধ্যে পরিচালক দুজন, উপপরিচালক চারজন, সহকারী পরিচালক ছয়জন এবং একজন সহকারী প্রোগ্রামার। বিভাগীয় কার্যালয়ে উপপরিচালক আছেন সাতজন এবং সহকারী পরিচালক আছেন ১৬ জন। এ ছাড়া ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সহকারী পরিচালক রয়েছেন। মূলত এই ১০১ জন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মাধ্যমেই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের ভোক্তার অধিকার সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। কারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পরিচালক, উপপরিচালক এবং সহকারী পরিচালকরাই কেবল বাজারে অভিযান চালান এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এর বিভিন্ন ধারামতে, অপরাধভেদে জরিমানা ও শাস্তি দেন। এ ছাড়া ভোক্তার লিখিত অভিযোগ নেওয়া, শুনানি করা এবং শুনানি শেষে জরিমানাও করেন এই কর্মকর্তারা। যদিও অধিদফতরে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির মোট ১৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন; কিন্তু তারা বাজারে অভিযান পরিচালনা করতে পারেন না। তারা কেবল ওই ১০১ কর্মকর্তার সহযোগী হয়ে কাজ করতে পারেন। ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিদফতরের যাত্রা শুরুর পর থেকেই এভাবে জনবল সঙ্কটে ধুঁকছে প্রতিষ্ঠানটি। এ সঙ্কট কাটাতে ২০১৯ সালে ২ হাজার ৬৫ জন জনবল নিয়োগের প্রস্তাব পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। তারও আগে ২৪০ জন জনবল নিয়োগের প্রস্তাব পাঠানো হয়। সব মিলিয়ে দুই দফায় ২ হাজার ৩০৫ জনের প্রস্তাব পাঠানো হলেও আজ অবধি নতুন করে কোনো জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অনেক দেন-দরবারের পর গত বছর ১৪৮ জন নন-ক্যাডার অফিসারের পদ অনুমোদন হলেও আজও চূড়ান্ত হয়নি। তবে সম্প্রতি ১২ জন নন-ক্যাডার অফিসার চূড়ান্ত নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু তারা এখনও কাজে যোগ দেননি। আগামী মাসে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। ভোক্তা অধিদফতরের জনবল সঙ্কটের বিষয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ  বলেন, অধিদফতরে জনবল নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। অনেক কাজ এগিয়েছে, দ্রুতই অধিদফতরে জনবল বাড়ানো হবে। এ বিষয়ে ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা  বলেন, জনবল সঙ্কটের কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমরা ভালো কাজ করতে পারছি না। তারপরও স্বল্প জনবলেই সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া চেষ্টা করছি। সাম্প্রতিক সময়ে ই-কমার্স নিয়ে অধিদফতরকে অনেক কাজ করতে হচ্ছে। প্রতিদিনই অসংখ্য অভিযোগ আসছে ই-কমার্স নিয়ে। এই জনবল দিয়েই নিয়মিত বাজারে অভিযানের পাশাপাশি ই-কমার্স সঙ্কটও মোকাবিলা করছি আমরা। গত কয়েক মাসে শুধু ইভ্যালির নামেই অভিযোগ এসেছে ৪ হাজার ৯৩২টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি করা হয়েছে ৪ হাজার ১৪৫টি। ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে ৩ হাজার ৭৮৪টি, দারাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে ১ হাজার ৫৩টি, আলেশা মার্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে ৪৬টি। এতসব অভিযোগ গ্রহণ, শুনানি এবং নিষ্পত্তি- সবই করা হচ্ছে এই জনবল দিয়ে। আরও ব্যাপক হারে কাজ করার জন্য অধিদফতরের জনবল বাড়ানো দরকার। তবে আশার কথা হচ্ছে, জনবল নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অধিদফতর জনবল বাড়ানোর যে প্রস্তাব পাঠিয়েছে তা পূরণ হবে ধীরে ধীরে। তবে ভোক্তা অধিদফতরের অনেক কর্মকর্তাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, শুধু জনবল বাড়ালেই হবে না, কর্মকর্তাদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন। কারণ বাজার অভিযানের সময় অনেক পণ্যের মান যাচাই করা লাগে। যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় এ ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে ই-কমার্স নিয়ে চলমান সঙ্কটে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম ক্ষেতে হচ্ছে অধিদফতরের কর্মকর্তাদের। কারণ এর আগে কখনও এই জটিল পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়নি তাদের। এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানও নেই কর্মকর্তাদের। অনেকটা ধারণার ওপর ভর করেই এ বিষয়ে কাজ করতে হচ্ছে। জনবল সঙ্কটের কারণে ভোক্তা অধিদফতরের কাজে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে জানতে চাইলে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান  বলেন, দেশের ১৭ কোটি ভোক্তার অধিকার সরাসরি দেখভাল করার একমাত্র প্রতিষ্ঠান ভোক্তা অধিদফতর। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ খুবই ভোক্তাবান্ধব আইন। এর সঠিক প্রয়োগ করা গেলে ভোক্তার অনেক অধিকার নিশ্চিত করা যাবে। কিন্তু অধিদফতরের জনবল সঙ্কটের কারণে এই আইনের সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তা। তাই প্রতিষ্ঠানটির জনবল বাড়াতে হবে। তবে শুধু জনবল বাড়ালেই হবে না, ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় অধিদফতরকে আরও জোরালোভাবে সারা দেশে কার্যক্রম চালাতে হবে।
Link copied!