শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৪৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতির প্রমাণ দুদকের হাতে

প্রকাশিত: ১১:৩৬ এএম, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২১

৪৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতির প্রমাণ দুদকের হাতে

প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার চক্রের বিরুদ্ধে ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অর্থের পরিমাণ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এমন ভয়াবহ তথ্য পায় দুদক। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসাবে ব্যবহার করে এই বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন পিকে হালদার। প্রসঙ্গত, ফাস ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের কোনো পদে ছিলেন না পিকে হালদার। তবে রহস্যজনক কারণে দুটি প্রতিষ্ঠানের সবকিছুই তিনি প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। আলোচিত এ ব্যক্তি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকও ছিলেন। জানতে চাইলে দুদক কমিশনার ড. মোজ্জাম্মেল হক খান বলেন, ‘অনুসন্ধান কার্যক্রম দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। কমিশনের তদন্ত কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। তাদের যথাযথ নির্দেশনাও দেওয়া আছে। অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদন কর্মকর্তা কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। এরপর তা পর্যালোচনা করে মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পিকে হালদার চক্রের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ১৫টি মামলা করা হয়েছে। মামলাগুলোর তদন্তও দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। এছাড়া পিকে চক্রের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের আরও অভিযোগের অনুসন্ধান কাজ চলছে। ২০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ওই অর্থ লোপাটের ঘটনায় পৃথকভাবে মামলা করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। কমিশনের অনুসন্ধান টিম মামলার সুপারিশ করে অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরি করেছে। শিগগির ওই প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করা হবে। এরপর অনুমোদন সাপেক্ষে মামলা হবে। দুদকের উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বাধীন একটি টিম পিকে চক্রের দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে। আসামির তালিকায় যাদের নাম : পিকে হালদার, সাবেক সিনিয়র সচিব (নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ফাস ফাইন্যান্সের পরিচালক) মো. আতাহারুল ইসলাম, ফাস ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান মো. সিদ্দিকুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক পরিচালক উজ্জ্বল কুমার নন্দী, আর্টিস্ট ও পরিচালক বীরেন্দ্র কুমার সোম, পরিচালক এমএ হাফিজ, পরিচালক সোমা ঘোষ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নাহিদা রুনাই, সাবেক এমডি সৈয়দ আবেদ হাসান, আরেক সাবেক এমডি মো. রাশেদুল হক, পরিচালক বাসুদেব ব্যানার্জি, পরিচালক পাপিয়া ব্যানার্জি, পরিচালক নওশারুল ইসলাম, পরিচালক নুরুজ্জামান, নিউট্রিক্যাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান স্বপন কুমার মিস্ত্রি, সুখাদা প্রপার্টিজ লিমিটেডের মালিক অমিতাভ অধিকারী, সন্দ্বীপ করপোরেশনের মালিক উত্তম কুমার মিস্ত্রি, আরবি এন্টারপ্রাইজের মালিক রতন কুমার বিশ্বাস, জিঅ্যান্ডজি এন্টারপ্রাইজের মালিক গোপাল চন্দ্র গাঙ্গুলী, হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের এমডি সুস্মিতা সাহা, কনিকা এন্টারপ্রাইজের মালিক প্রসাদ রায়, মুন এন্টারপ্রাইজের মালিক শঙ্খ ব্যাপারীসহ ৭৫ জন। যেভাবে অর্থ লোপাট : ফাস ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ২০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে ঋণের নামে ওই অর্থ লোপাট করা হয়েছে। ওইসব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মালিক, এমডি কিংবা চেয়ারম্যান- সবাই পিকে হালদারের মাসিক বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিলেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে ঋণ দেওয়া হলেও ঋণের অর্থ চলে যেত পিকে হালদারের নির্দেশিত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে। কোনো প্রকার মর্টগেজ ছাড়াই এসব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ দেওয়া হয়েছে। আর অস্তিত্বহীন এসব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণের পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন স্বয়ং পিকে হালদার। যেসব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ লোপাট : পিকে হালদারের নির্দেশে ২০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এগুলো হলো- এসএ এন্টারপ্রাইজ, মুন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, সুখাদা প্রোপার্টিজ লিমিটেড, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ, আরবি এন্টারপ্রাইজ, দিয়া শিপিং লিমিটেড, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, মেসার্স বর্ণ, কনিকা এন্টারপ্রাইজ, দ্রিনান অ্যাপারেলস, এন্ডবি এন্টারপ্রাইজ, এমার এন্টারপ্রাইজ, জিঅ্যান্ডজি এন্টারপ্রাইজ, তামিম অ্যান্ড তালহা, হাল ইন্টারন্যাশনাল, মেরিন ট্রাস্ট লিমিটেড, আর্থস্কোপ, এমটিবি মেরিন লিমিটেড ও পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। পিকে হালদারের অবৈধ সম্পদের মামলা : চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ২৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। একই দিন তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল। অবৈধ সম্পদের মামলায় দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে দুই দফায় পিকে হালদারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজের আদেশ দিয়েছেন আদালত। পিকে হালদার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আইএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে বছরের শুরুতেই তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে করা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। অন্যান্য মামলা, গ্রেফতার ও স্বীকারোক্তি : ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ভুয়া ঋণের নামে আত্মসাতের অভিযোগে ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা এবং ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৩ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচ মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় পিকে হালদারসহ অন্যদের আসামি করা হয়। পিকে হালদারকাণ্ডে অদ্যাবধি বিভিন্ন সময় ১১ জন গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের মধ্যে পিকের অন্যতম সহযোগী শঙ্খ বেপারী, রাশেদুল হক, উজ্জ্বল কুমার নন্দী, সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধা আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বর্তমানে আসামিরা কারাগারে আছেন।
Link copied!