শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৭০ কোটি টাকা গচ্চা দিয়ে প্লটের শ্রেণি বদল

প্রকাশিত: ১১:০৩ এএম, অক্টোবর ২৮, ২০২১

৭০ কোটি টাকা গচ্চা দিয়ে প্লটের শ্রেণি বদল

জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) মিরপুর ডিভিশনের আওতায় বাণিজ্যিক প্লট ছিল ৪২টি। নিয়ম অনুযায়ী এসব প্লট বরাদ্দ দিতে হলে নিলামের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতাকে দিতে হবে। সেই লক্ষ্যে ২০১৮ সালে জাগৃক ও প্রাশাসনিক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালির মাধ্যমে কিছুটা দাপ্তরিক কাজও করে সংস্থাটি। কিন্তু মাঝপথে এসে প্রভাবের জোরে প্লটের শ্রেণি পরিবর্তন করে আবাসিক হিসেবে মোট নয়টি প্লট বরাদ্দ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মিরপুর-১ নম্বর সেকশনে চিড়িয়াখানা রোডের শুরুতে এসব বাণিজ্যিক প্লটের অবস্থান হওয়ায় এবং বর্তমান বাজারমূল্য প্রতি কাঠা কমপক্ষে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা। কিন্তু জাগৃকের বরাদ্দ নির্দেশিকা উপেক্ষা করে এসব প্লট আবাসিক হিসেবে প্রতি কাঠা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫০ লাখ টাকায়। ফলে এই ২৫ দশমিক ৭৬ কাঠা জমির বাজারমূল্যের চেয়ে কমপক্ষে ৭০ কোটি টাকা সরকারের এ সংস্থা লোকসান করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জাগৃকের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, কর্তৃপক্ষের ২১০তম বোর্ড সভায় মিরপুরের ১ নম্বর সেকশনের চিড়িয়াখানা রোডের জি-ব্লকের ২৫ দশমিক ৭৬ কাঠার প্লটটির জন্য মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ সামসুল হকসহ মোট ২৭ জন আবেদন করেন। তাদের আবেদনের পর সর্বপ্রথম দাপ্তরিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০০৯ সালের ১১ নভেম্বর ঢাকা ডিভিশনের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী একটি প্রতিবেদন দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী এখানে বাণিজ্যিক প্লট ২৫ হতে ৩৩ পর্যন্ত চিহ্নিত আছে যেখানে নয়টি প্লটে মোট ২৫ দশমিক ৭৬ কাঠা জমি। ডালাস মাল্টিপারপাস লিমিটেডের নামে মো. সামসুল হক প্লটটি বরাদ্দের জন্য আবেদন করেন। বর্তমানে দুটি সমিতি এসব জমি দখলে রেখে দোকানপাট নির্মাণ করে ভাড়া দিচ্ছে। বিধি অনুযায়ী নিলাম দরপত্রের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতার অনুকূলে বাণিজ্যিক প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে।’ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিষয়টি শুরুতেই দুটি সমিতি বরাদ্দ নেওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল। প্রথমে জাগৃকের ৭৬তম বোর্ড সভায় তা উত্থাপন করা হয়। সেখানে মাস্টার প্ল্যানে থাকা ৯টি বাণিজ্যিক প্লটের নকশা বোর্ড সভায় অনুমোদন হয়। এরপর ১০০তম বোর্ড সভায় আবারও উঠে বিষয়টি। এরপর সেখানে গৃহায়নের বরাদ্দ নির্দেশিকা ২০০৮ (সংশোধনী ২০১৩) অনুযায়ী বাণিজ্যিক প্লটকে রূপান্তরের কোনো বিধান নেই মর্মে আলোচনা হয়। এভাবে ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ই তা কর্তৃপক্ষের বোর্ড সভায় উত্থাপিত হয়ে আসছিল। দীর্ঘ এক যুগ পর গত বছর ১৫ জুলাই কর্তৃপক্ষের ২১০তম বোর্ড সভায় বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২১০তম বোর্ড সভার কার্যবিবরণী হতে দেখা যায়, সরকারের এ মূল্যবান জমি নিজেদের করে নিতে একসময় যারা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ছিল তারা দুটি সমিতির নামে সমঝোতার কাগজপত্র দাখিল করেছে। সমঝোতার সেই কাগজপত্র আর ত্রিপক্ষীয় মামলা-মোকাদ্দমার বিষয়েও কর্তৃপক্ষের আইন কর্মকর্তার মতামতও আমলে নেয় বোর্ড সভা। সমিতির সদস্য সবাই মুক্তিযোদ্ধা বলেও উল্লেখ করা হয়। জাগৃকের ভূমি শাখা আর আইন শাখার অনাপত্তি পেয়ে বোর্ড দুটি বড় ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একটি হলো বাণিজ্যিক প্লটকে আবাসিক গ্রুপ প্লটে রূপান্তর করা এবং গ্রুপ প্লট হিসেবে আবেদনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের নামে প্রচলিত মূল্যে বরাদ্দ দেওয়া। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘মিরপুরের প্রাণকেন্দ্রের এ প্লটগুলো বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপর দুটি সমিতির সাইনবোর্ড টানিয়ে দখলে নেয় একটি মহল। এরপর তারা সরকারের শীর্ষপর্যায়ের লোকজনদের মাধ্যমে বেশ কয়েকবার বরাদ্দ নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাণিজ্যিক এসব প্লট ব্যক্তি বা সমিতির নামে সরাসরি বরাদ্দ দেওয়ার আইনগত সুযোগ না থাকায় সংশ্লিষ্টরা সফল হতে পারেনি। এরপর এ কাজের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত করে যুবলীগের উত্তরের শীর্ষপর্যায়ের একজন নেতাকে। এ নেতা যুবলীগে আরও বড় দায়িত্বে আসার পর তদবির আরও জোরালো হতে থাকে। কর্মকর্তারা বলছেন, তার হস্তক্ষেপে কাজটি বাগিয়ে নেয় সংশ্লিষ্টরা। গৃহায়নের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ডিভিশন-১-এর তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী তানজিলা খানম প্রধান কার্যালয়ে বাণিজ্যিক প্লটের একটি প্রতিবেদন পাঠান। সেখানে মোট ৪২টি বাণিজ্যিক প্লটের তালিকায় রয়েছে এ ৯টিও। এরপর তৎকালীন চেয়ারম্যান খন্দকার আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে এই বছরের ২০ মার্চ একটি বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এ সংস্থার আরও কিছু প্লটসহ সব জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিলামের মাধ্যমে বরাদ্দের সিদ্ধান্তের জন্য পূর্ত মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এরপর এ চিঠি পেয়ে একই বছর পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার উপসচিব মো. রফিকুল ইসলাম গত ১৯ জুন গৃহায়নের চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দেন। সেখানে তিনি এ ৪২টি বাণিজ্যিক প্লটসহ মোট ৬৩টি বিধিমালা অনুযায়ী নিলামে তুলে বিক্রি করার জন্য চিঠি দেন। এরই মধ্যে মাঝখান থেকে ৯টি প্লটের মোট ২৫ দশমিক ৭৬ কাঠা আবাসিক মূল্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গৃহায়নের ১৯৭তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মিরপুর সেকশনের ৮০ ফুটের ঊর্ধ্বে সড়কের পাশের আবাসিক জমির মূল্য কাঠাপ্রতি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সে হিসাবে এ জমির দাম ১৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার মতো হয়। কিন্তু বাস্তবে এখানে কাঠাপ্রতি জমির বর্তমান বাজারমূল্য কমবেশি ৩ কোটি টাকার মতো। সেই হিসাবে জমির মোট মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৮৩ কোটি টাকা। তাই কর্তৃপক্ষের ভূমি শাখা ও আইন শাখাকে সংশ্লিষ্টরা কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যিক প্লটকে আবাসিক করে তা বরাদ্দ দিয়ে সরকারের কমপক্ষে ৭০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি করেছে। এ জমি সমিতির লোকজন বরাদ্দ নিয়েই একটি ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে। এ ডেভেলপারও এখানে ভবন করে বাণিজ্যিক হিসেবেই বিক্রি করবে। আর সেই অংশ ভাগাভাগির মাধ্যমে এ কাজটি বাস্তবায়ন করেছে যুবলীগের সেই শীর্ষ নেতা। এ নেতাকে বিষয়টি নিয়ে সশরীরে বেশ কয়েকবার গৃহায়ন ভবনে ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাগৃকের চেয়ারম্যান মো. দেলওয়ার হায়দার বলেন, ‘বোর্ড সভায় সব সদস্যের সিদ্ধান্তে এটি করা হয়েছে। এখানে মূলত ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে একটি সমিতির নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু নয়।’ জাগৃকের সদস্য (ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা) ড. মইনুল হক আনছারী বলেন, ‘এই মুহূর্তে বিষয়টি আমি বলতে পারছি না। আমাদের মিরপুরের (নির্বাহী প্রকৌশলী) বলতে পারবে।’ জাগৃকের উপপরিচালক (ভূমি) কমল কুমার ঘোষ বলেন, ‘এমন একটি বিষয় থাকতে পারে। তা বিস্তারিত চেয়ারম্যান বা মেম্বার স্যার বলতে পারবেন। আমি কোনো তথ্য বা মন্তব্য করতে পারছি না।’ গৃহায়নের ঢাকা ডিভিশন-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী জোয়ার্দার তাবেদুন নবী বলেন, ‘এ সংক্রান্ত কোনো রিপোর্ট ডিভিশন অফিস থেকে নেওয়া হয়নি। আমার কর্মকালীন এ ধরনের ঘটনাও ঘটেনি। এর বেশি কোনো তথ্য আমার কাছে নেই।’ প্রশাসনিক কর্মকর্তা (মিরপুর হাউজিং এস্টেট) আকলিমা খানম বলেন, ‘আমাদের অফিসের নথিপত্র ঘেঁটে এ সংক্রান্ত কোনো ফাইল পাওয়া যায়নি। এছাড়া প্রশাসনিক কার্যালয় থেকে কোনো প্রতিবেদনও নেওয়া হয়নি।’ জাগৃকের আইন কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামানের বক্তব্য জানতে তার ব্যক্তিগত ফোনে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
Link copied!