ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে অর্ন্তবতী সরকার এবার তিনটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে। দেশ ৩টি হচ্ছে-যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সুইজারল্যান্ড। এসব দেশের পৃথক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিগগির এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় অফিশিয়াল প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে। এ সংক্রান্ত নথি বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। চুক্তি সম্পন্ন হলে উদ্ধারকৃত অর্থের ১০ ভাগ কমিশন হিসাবে পাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সফলতার নজির রয়েছে। বিশ্বজুড়ে রয়েছে তাদের শাখা অফিসের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। সরকারের বিভিন্ন সুত্রের সাথে অঅলাপ বরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে প্রকাশিত অর্থনীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার করে পাচার হয়েছে। এ হিসাবে দেশ থেকে ১৫ বছরে পাচার হয়েছে ২৮ লাখ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, যেসব প্রতিষ্ঠান বা এজেন্সি নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তাদের পাচার করা অর্থ উদ্ধারে তথ্যের অনুসন্ধান,অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া, সংশ্লিষ্ট দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং প্রয়োজনে আইনি লড়াই করার মতো সব ধরনের সামর্থ্য রয়েছে। এছাড়া একই সময়ে একাধিক দেশে কাজ করার যথেষ্ট সক্ষমতাও আছে। ফলে পাচার করা টাকা ফেরাতে এসব এজেন্সি নিয়োগ দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত মনে করছে অর্ন্তবতী সরকার। এজন্য চুক্তি হওয়ার পর এজেন্সিগুলোর সঙ্গে সরকারের বিদেশে অবস্থিত দূতাবাস বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সর্বক্ষণিকভাবে যোগাযোগ রাখবেন।
মূলত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর সহায়তা নিয়েই বেশ কয়েকটি এজেন্সিকে বাছাই করেছে সরকারের এ সংক্রান্ত টাস্কফোর্স। এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা করে প্রাথমিকভাবে উল্লিখিত তিনটি এজেন্সিকে বাছাই করা হয়। তবে গোপনীয়তা রক্ষার প্রশ্নে এজেন্সিগুলোর নাম প্রকাশ হচ্ছে না।
প্রাথমিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তিবদ্ধ এজেন্সিকে দেশ থেকে টাকা পাচার করেছেন এমন সন্দেহভাজনদের নাম-ঠিকানা সরবরাহ করা হবে। যেখানে তাদের পাসপোর্ট নম্বরও থাকবে। ওইসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে পাচার করা অর্থ-সম্পদের যেসব তথ্য সরকারের কাছে রয়েছে সেগুলো এজেন্সিকে দেওয়া হবে। এর ভিত্তিতে এজেন্সিগুলো প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করবে। তাদের অনুসন্ধানে পাচার হওয়া সম্পদের তথ্য নিশ্চিত করা গেলে সে বিষয়ে এজেন্সি ওই দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
জানা গেছে,বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধারে সাফল্যের নজির রয়েছে এসব এজেন্সির। ভারত সরকারও এ ধরনের এজেন্সি নিয়োগ দিয়ে পাচার করা অর্থের তথ্য সংগ্রহ করেছে। পরে তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। একই ভাবে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে বিদেশে সম্পদ রাখার তথ্যও উদ্ঘাটন করেছে।
সূত্র জানায়,বিএফআইইউ থেকে আন্তর্জাতিক এজেন্সি নিয়োগের ব্যাপারে বলা হয়েছে, নগদ অর্থ দিয়ে কোনো চুক্তি না করে শুধু উদ্ধার করা অর্থের বিপরীতে কমিশন দেওয়া বা পার্টনারশিপের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া উচিত। এতে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হবে। এর আগে রিজার্ভ চুরির মামলা পরিচালনা করতে নিউইয়র্কে একটি ফার্ম নিয়োগ দেওয়া হয় নগদ অর্থের ভিত্তিতে। তাদের সঙ্গে পার্টনারশিপ কোনো চুক্তি করা হয়নি। ফলে সরকারকে ওই ফার্মকে এখনো টাকা দিতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪ কোটি টাকার বেশি দেওয়া হয়েছে। অথচ রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এতে শুধু সরকারের টাকা গচ্চা যাচ্ছে।
এদিকে অর্থ উদ্ধারে এ ধরনের ফার্ম নিয়োগ দেওয়ার আগে ১০টি দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর ভিত্তিতে ওইসব দেশেও ফার্ম নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিএফআইইউর প্রণীত এ সংক্রান্ত নীতিমালা এবং প্রস্তাবনা বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে।
এছাড়া পাচার করা অর্থের বিষয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইড) দেশে-বিদেশে অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে পাচারকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও হচ্ছে। এসব মামলার রায় সরকারের পক্ষে এলে সেগুলো এজেন্সিগুলোর কাছে পাঠানো হবে। এতে তাদের সংশ্লিষ্ট দেশে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করে অর্থ উদ্ধার করা সহজ হবে। পাচার করা টাকা উদ্ধার করতে সরকার মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই),যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া ও সুইজারল্যান্ডের সহযোগিতা চেয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণ করে সহযোগিতা চাইলে তারা তা করতে সম্মত হয়েছে।
এদিকে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এফবিআইয়ের নিজস্ব নেটওয়ার্ক রয়েছে। সেই নেটকওয়ার্ক ব্যবহার করেও পাচার করা অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে এফবিআইয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, পাচার করা অর্থ ফেরানোর প্রক্রিয়াটি জটিল ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার হলেও আন্তর্জাতিক এজেন্সির মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ শনাক্ত করা গেলে এবং গ্রাহক সেই টাকার বৈধ উৎস দেখাতে না পারলে আদালতের বাইরে দুদেশের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ও প্রচলিত আইন-কানুন অনুসরণ করে পাচারকৃত অর্থ ফেরানো সম্ভব হবে। এতে সময় যেমন কম লাগবে, তেমনি জটিলতাও কম হবে। এ কারণে সরকার পাচার করা অর্থ ফেরাতে এই পথেই হাঁটছে। কারণ ভারত, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র এই প্রক্রিয়ায়ই তথ্য সংগ্রহ করেছে। এই প্রক্রিয়ার পাচার করা টাকা উদ্ধার করতে সরকারের অর্থ খরচও কম হবে। পাচার করা অর্থ উদ্ধার করে তা বিদেশে বাংলাদেশের যে কোনো ব্যাংকের হিসাবে জমা করলে ওই অর্থ থেকে ১০ শতাংশ অর্থ এজেন্সিকে দেওয়া হবে। এর বাইরে এজেন্সিকে তথ্যগত ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হবে। তবে নগদ অর্থ দেওয়া হবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএফআইইউর প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে, এর মধ্যে সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রæপ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রæপ, সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন নাসা গ্রæপ এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের মতো রাঘববোয়ালরা দেশ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার করেছেন। এছাড়াও আরও ৭টি গ্রæপের বিষয়ে বিশেষ তদন্ত হচ্ছে। এর বাইরে সাবেক সরকারের একাধিক মন্ত্রীও টাকা পাচার করেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে সালমান এফ রহমান, এস আলম গ্রæপ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও নাসা গ্রæপের পাচার করা অর্থ-সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো উদ্ধারের বিষয়ে সরকার কাজ করছে।
সূত্র জানায়, ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিং বা আমদানি-রপ্তানির আড়ালে যেসব অর্থ পাচার করা হয়েছে সেগুলো সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব। এসব অর্থ ফেরত আনাও সহজ হবে। প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের কারণে এসব অর্থের তথ্য-প্রমাণ পেতে বেশি বেগ পেতে হবে না।
অবশ্য সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, পাচারকৃত অর্থ ফেরানো খুব সহজ হবে না। কারণ,যে দেশে পাচার করা হয়েছে সেই দেশের আইন ও বাংলাদেশের আইনের মধ্যকার সমন্বয় থাকতে হবে। এছাড়া সব দেশের আইন আমানতকারীদের সুরক্ষা দেয়। যিনি যে দেশে টাকা পাচার করেছেন সে দেশে তিনি আমানতকারী হিসাবে সুরক্ষা পাবেন। তবে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে কর ফাঁকি ও মানি লন্ডারিংয়ের মতো অপরাধের প্রমাণ করা গেলে তা ফিরিয়ে আনা সহজ হবে। আর মোক্ষম সুযোগটি এখানে। কেননা, যারা অর্থ পাচার করে তারা এ দুটি অপরাধ বেশি করে থাকে।অর্থপাচারকারি দেশ ও জাতির শত্রæ হলেও স্বৈরাচার সরকার তাদের মাথায় ছায়া দিয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :